সিরিয়ার উদ্বাস্তু বেদুঈন পরিবারগুলোর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় দারা প্রদেশের আবতা শহরের একটি বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষগুলোতে এখন আশ্রয় নিয়েছে কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা। ঘরগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছেন বেদুঈন সম্প্রদায়ের মানুষ। এক মাস আগে প্রতিবেশী সুয়াইদা প্রদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে তারা তাদের গ্রামগুলো থেকে বিতাড়িত হন।
এরপর থেকে, দামেস্কের কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্থানীয় দ্রুজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষগুলো এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
৫৬ বছর বয়সী মুনিরা আল-হামাদ, যিনি সুয়াইদা প্রদেশের আল-কাফর গ্রাম থেকে এসেছেন, তার পরিবারের সাথে বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বিদ্যালয়টি এই মাসেই আবার চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
এমনটা হলে, তাদের কোথায় যেতে হবে, তা তিনি জানেন না।
মুনিরা বলেন, “আমরা তাঁবুতে থাকতে চাই না। আমরা চাই সরকার আমাদের জন্য বাড়ি অথবা থাকার মতো উপযুক্ত জায়গা খুঁজে দিক। এখানে কারও পক্ষে আর নিজেদের গ্রামে ফেরা সম্ভব নয়।
কারণ, আপনি মুসলিম হলে, সুয়াইদাতে তারা আপনাকে শত্রু হিসেবে দেখবে।”
গত মাসে স্থানীয় সুন্নি মুসলিম বেদুঈন গোষ্ঠী এবং দ্রুজ সম্প্রদায়ের কিছু সদস্যের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে ঘটনার সূত্রপাত হয়। দ্রুজরা সিরিয়ায় সংখ্যালঘু হলেও সুয়াইদাতে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ধীরে ধীরে এই সংঘর্ষ বেদুঈন ও সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দ্রুজ সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক লড়াইয়ে রূপ নেয়। ইসরায়েল দ্রুজদের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে বিমান হামলা চালায়।
এতে, বেশিরভাগ দ্রুজ সম্প্রদায়ের কয়েকশ বেসামরিক লোক নিহত হয়। এরপর থেকে সুয়াইদাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।
সেখানে সাহায্য ও সরবরাহ সীমিত আকারে প্রবেশ করছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, তারা সরকারি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী কর্তৃক সংঘটিত ৪৬টি ‘দ্রুজ নারী ও পুরুষের ইচ্ছাকৃত ও বেআইনিভাবে হত্যার’ ঘটনা নথিভুক্ত করেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, লড়াই কমে গেলেও এখনো ১ লাখ ৬৪ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছে। এদের মধ্যে সুয়াইদার অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত দ্রুজ এবং প্রদেশ থেকে পালিয়ে আসা বা সরিয়ে নেওয়া বেদুঈনরাও রয়েছেন।
তাদের ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, যা একটি স্থায়ী জনসংখ্যার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
মুনিরা আল-হামাদ জানান, তাদের পরিবার ‘১৫ দিন ধরে অবরোধের মধ্যে ছিল, কোনো রুটি বা কিছুই আসছিল না’। এরপর সিরিয়ান আরব রেড ক্রিসেন্ট তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেয়।
তিনি আরও জানান, তার চাচাতো ভাই ও এক প্রতিবেশীর ওপর সশস্ত্র লোকেরা হামলা চালিয়েছিল এবং তাদের বহন করা মালামালসহ গাড়িও লুট করা হয়।
২৪ বছর বয়সী জাররাহ আল-মোহাম্মদ বলেন, যখন তাদের গ্রাম সাহওয়াত বালাতায় লড়াই শুরু হয়, তখন অনেক বাসিন্দা রাতের বেলা হেঁটে পালাতে বাধ্য হন।
দ্রুজ মিলিশিয়াদের গুলিতে ওই এলাকার নয়জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী তিনজন শিশুও ছিল। তিনি আরও জানান, তাদের ঘরবাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আসবাবপত্র লুট করা হয়েছে।
জাররাহ বলেন, “আমরা সুয়াইদাতে ফিরতে পারি না—আমাদের ও দ্রুজদের মধ্যে আর কোনো নিরাপত্তা নেই। আর আমরা তো সুয়াইদাতে সংখ্যালঘু।”
দামেস্কের শহরতলিতে সাইয়িদা জেইনাবের একটি হোটেলে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেখানে হামুদ আল-মুখমাস ও তার স্ত্রী মুনিরা আল-সায়্যাদ তাদের ২১ ও ২৩ বছর বয়সী দুই ছেলের মৃত্যুতে শোকাহত।
তারা জানান, তাদের দুই ছেলেকে সশস্ত্র মিলিশিয়ারা গুলি করে হত্যা করেছে। হামুদের ভাগ্নি ও চাচাতো ভাইও নিহত হয়। তারা নিরস্ত্র অবস্থায় শাহবা শহর থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিল।
মুনিরা আল-সায়্যাদ হোটেলে থাকতে রাজি নন, কারণ সেখানে ছোট বাচ্চাদের জন্য রান্না করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। পরিবারটি জানিয়েছে, তাদের কাছে খাবারও অনিয়মিতভাবে পৌঁছাচ্ছে।
হামুদ আল-মুখমাস বলেন, “আমার সাহায্য দরকার, আমার টাকারও প্রয়োজন—আমাদের কোনো ঘর নেই। আমার মনে হয় না আমরা ফিরতে পারব—আমরা ফিরলে দেখব দ্রুজরা আমাদের বাড়িতে বসবাস করছে।”
সরকার বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের বিষয়ে এখনো কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা জানায়নি।
আরব রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ এবং চ্যাথাম হাউসের গবেষণা ফেলো হায়িদ হায়িদ বলেন, “সরকার বাস্তুচ্যুতদের কত দিনের মধ্যে ফিরিয়ে আনবে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কী ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা রয়েছে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, বাস্তুচ্যুতদের নিজ নিজ ঘরে ফেরানোর জন্য সম্ভবত একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজন, যা এখনো অনেক দূরের বিষয় বলে মনে হচ্ছে।
কারণ, দামেস্কের সরকার এবং সুয়াইদার কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত সরাসরি কোনো আলোচনা শুরু করেনি।
সুয়াইদার বিশিষ্ট দ্রুজ নেতা শেখ হিকমাত আল-হিজরি, দক্ষিণাঞ্চলীয় সিরিয়ার স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছেন, যা দামেস্ক প্রত্যাখ্যান করেছে। সম্প্রতি তিনি কয়েকটি দ্রুজ সশস্ত্র গোষ্ঠী নিয়ে একটি ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
কিছু মানুষের কাছে, এই পরিস্থিতি সিরিয়ার ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। সে সময় প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরোধীদের সরকার বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়।
তাদের পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত সবুজ বাসগুলো অনেকের কাছে নির্বাসন ও পরাজয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ঐতিহাসিকভাবে, বেদুঈনরা সুয়াইদার আদি বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত, যারা মূলত পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। ১৮ শতকে লেবাননে সহিংসতার শিকার হয়ে দ্রুজরা এখানে পালিয়ে আসে।
এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সহাবস্থান থাকলেও মাঝে মাঝে উত্তেজনা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
২০০০ সালে, ভূমি নিয়ে বিরোধের জেরে এক বেদুঈন ব্যক্তি এক দ্রুজকে হত্যা করে এবং এর জেরে সরকারি বাহিনী দ্রুজ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়।
২০১৮ সালে ইসলামিক স্টেট গ্রুপ (আইএস)-এর হামলায় সুয়াইদাতে ২০০ জনের বেশি দ্রুজ নিহত হওয়ার পর, দ্রুজরা বেদুঈনদের জঙ্গিদের সাহায্য করার অভিযোগ করে।
সর্বশেষ ঘটনার সূত্রপাত হয় সুয়াইদার একটি বেদুঈন গোত্রের একটি চেকপোস্ট স্থাপন ও এক দ্রুজকে আক্রমণের মধ্য দিয়ে।
এরপর প্রতিশোধমূলক হামলা ও অপহরণের ঘটনা ঘটে। তবে এর আগেও সেখানে উত্তেজনা বাড়ছিল।
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আল-কাফর থেকে বিতাড়িত এক বেদুঈন ব্যক্তি জানান, ২০১৮ সালে তার ভাইকে হিজরির সঙ্গে যুক্ত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার কয়েক দিন আগে একদল সশস্ত্র লোক তাদের বাড়িতে এসে তার বাবাকে ঘর লিখে দেওয়ার জন্য একটি কাগজে সই করতে বাধ্য করে।
তিনি বলেন, “সব দ্রুজ খারাপ মানুষ নয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের প্রতি সদয় ছিল, তবে কিছু খারাপ যোদ্ধা ছিল।”
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “যদি রাষ্ট্র আমাদের ঘরবাড়ি পুনরুদ্ধার করতে কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আমরা নিজেদের অধিকার নিজেরাই আদায় করব।”
নিহত দুই যুবকের মা আল-সায়্যাদও প্রতিশোধের কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমি চাই সরকার তাদের সঙ্গেও তাই করুক, যা তারা আমার ছেলেদের সঙ্গে করেছে।”
হায়িদ বলেন, আন্তঃসাম্প্রদায়িক উত্তেজনা হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসবে, তবে বর্তমানে তা দামেস্ক ও সুয়াইদার মধ্যে বৃহত্তর রাজনৈতিক ইস্যুর চেয়ে গৌণ হয়ে পড়েছে।
“যদি এই বিভেদ দূর করতে কোনো ধরনের সংলাপ না হয়, তাহলে স্থানীয় বিরোধগুলোর সমাধান হওয়া কঠিন।”
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস