সেলিব্রিটিদের ড্রাফট ফাঁকি: তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী কি প্রস্তুত?

তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীতে নামকরা তারকাদের ড্রাফট ফাঁকির ঘটনা, বাড়ছে উদ্বেগ।

তাইওয়ানে সম্প্রতি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া থেকে বাঁচতে কয়েকজন অভিনেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সঙ্গীতশিল্পীর বিরুদ্ধে ভুয়া মেডিক্যাল সনদ ব্যবহার করে ড্রাফট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী এবং রিজার্ভ ফোর্স নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, যা চীনের সম্ভাব্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে।

অভিযোগ উঠেছে, তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী, যারা নিয়মিত সেনাদের পাশাপাশি রিজার্ভ ফোর্সের মাধ্যমেও দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে, তারা সেনাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাইওয়ানের প্রতিবেশী দেশ চীনের ক্রমবর্ধমান হুমকি ও সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রেক্ষাপটে এমন অভিযোগ নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়।

এই ঘটনার তদন্তে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন সেলিব্রিটির নাম এসেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন অভিনেতা ড্যারেন ওয়াং। জানা গেছে, তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া থেকে বাঁচতে উচ্চ রক্তচাপের ভুয়া সনদ তৈরি করার জন্য প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকার বেশি খরচ করেছেন। তাইওয়ানের পুরুষ নাগরিকদের ১৯ থেকে ৩৬ বছর বয়সের মধ্যে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক।

সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া এড়ানোর জন্য এমন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা আসলে সেনাদের প্রতি জনগণের অনীহারই প্রমাণ দেয়। তাইওয়ানের ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন গবেষক জানিয়েছেন, “সেনা প্রশিক্ষণে ক্লান্তি নয়, বরং সময়ের অপচয় বোধটাই সেনাদের হতাশ করে।” তার মতে, প্রশিক্ষণের বেশিরভাগ সময় যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কহীন নানা কাজে ব্যয় হয়।

১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাইওয়ানে পালিয়ে আসে কুওমিনতাং সরকার। এরপর থেকে এখানে বাধ্যতামূলক সামরিক সেবার ব্যবস্থা চালু হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, প্রয়োজনে চীন যদি তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ হিসেবে নিতে চায়, তবে তার মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকা।

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই তাইওয়ানের সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। অনেক সেনা সদস্য একে একঘেয়ে, অসংগঠিত এবং আধুনিক যুদ্ধ থেকে দূরে থাকা একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে, এখানে পুরোনো দিনের নিয়মকানুন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা এবং আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ-এর মতো বিষয়গুলোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারাও তাইওয়ানের রিজার্ভ ফোর্স নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাদের মতে, কাগজে-কলমে রিজার্ভ ফোর্সের সদস্য সংখ্যা অনেক হলেও, নিয়মিত প্রশিক্ষণের অভাবে তারা আধুনিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সামরিক সেবা ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্তের সংখ্যা বেড়েছে। তাইওয়ানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এই সময়ে এ ধরনের ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাইওয়ানের সামরিক সেবার সংস্কার জরুরি। কারণ, অস্ত্র যাই হোক না কেন, যুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত লড়তে হয় সেনাদেরই। তাই তাদের ভালো প্রশিক্ষণ ও উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাইওয়ানের নেতারাও অবশ্য এই সমস্যাটি স্বীকার করেছেন। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক তৎপরতার কারণে তাইওয়ানের সরকার সম্প্রতি সেনাদের প্রশিক্ষণের সময়সীমা বাড়িয়েছে এবং আধুনিক যুদ্ধকৌশলের ওপর জোর দিচ্ছে। বর্তমানে, সেনাদের জন্য এক বছরের সক্রিয় ডিউটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা আগে ছিল মাত্র চার মাস।

তবে, সমালোচকদের মতে, সেনাদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এবং বিষয়বস্তু পরিবর্তন না করলে তরুণ প্রজন্মের কাছে সামরিক সেবা কেবল আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই থেকে যাবে।

অন্যদিকে, তাইওয়ানের প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক সেবাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। সেখানে তারকাদের সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়াটা দেশপ্রেম ও সততার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। সম্প্রতি, জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটিএস-এর দুই সদস্য আরএম ও ভি তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন এবং ভক্তরা তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।

সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীতে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করতে হবে, প্রশিক্ষণের মান উন্নত করতে হবে এবং আধুনিক যুদ্ধ পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রশিক্ষণ সাজাতে হবে। একইসঙ্গে, সামরিক সেবা যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে দেশের সুরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচিত হয়, সেই মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *