চিপ উৎপাদন: যুক্তরাষ্ট্রের দাবি মানতে নারাজ তাইওয়ান, উত্তেজনা!

তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকটা যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রত্যাখ্যান করতে চলেছে তাইওয়ান। তাইওয়ানের এমন সিদ্ধান্তের ফলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। প্রযুক্তিখাতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে তাইওয়ানের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্র চাইছে তাইওয়ানের চিপ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে টিএসএমসি (TSMC), তাদের উৎপাদনের একটা বড় অংশ যেন যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপন করে। এর কারণ হলো, তাইওয়ানের উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর সেমিকন্ডাক্টর বা চিপের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা। এনভিডিয়া (Nvidia) ও অ্যাপলের (Apple) মতো বড় বড় কোম্পানির জন্য প্রয়োজনীয় উন্নত চিপের সিংহভাগ সরবরাহ করে টিএসএমসি। এই পরিস্থিতিতে তাইওয়ানের নিরাপত্তা নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ বাড়ছে।

অন্যদিকে, তাইওয়ানের অনেকে মনে করেন, তাদের চিপ তৈরির ক্ষমতা তাদের জন্য একটি ‘সিলিকন শিল্ড’-এর মতো, যা চীনের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করতে সহায়ক হবে। তাইওয়ানের ভাইস প্রিমিয়ার চ change লি-চিউন বুধবার জানান, তাইওয়ান “যুক্তরাষ্ট্রে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের ৫০ শতাংশ” করতে রাজি হবে না। এই সেমিকন্ডাক্টরগুলো ইলেকট্রনিকস, আইফোন থেকে শুরু করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (artificial intelligence) ও সামরিক সরঞ্জাম—সবকিছুতেই অপরিহার্য।

মার্কিন বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিক সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তাইওয়ানের কাছে তাদের চিপ উৎপাদনের অর্ধেকটা যুক্তরাষ্ট্রে সরানোর দাবি জানান। এই ঘটনায় তাইওয়ানের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দলের নেতারা এবং বিশেষজ্ঞরা এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। লুটনিক “সিলিকন শিল্ড”-এর ধারণা উল্লেখ করে বলেন, তাইওয়ানের সুরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চিপ উৎপাদন বাড়াতে হবে। তার মতে, তাইওয়ানের চিপের ৯৫ শতাংশ যদি তাদের কাছে থাকে, তাহলে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের রক্ষা করবে?

চীনের তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করা এবং প্রয়োজনে জোর করে অঞ্চলটি দখলের ঘোষণার প্রেক্ষাপটে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। লুটনিক আরও জানান, তাইওয়ানের সঙ্গে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে এবং ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি চিপের বাজার হিস্যা “৪০ থেকে ৫০ শতাংশ” পর্যন্ত বাড়ানো। তবে তাইওয়ানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এই প্রস্তাব নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

তাইওয়ানের বিরোধী দল কুওমিংতাংয়ের (KMT) আইনপ্রণেতা, শু ইউ-চেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবিকে “সরাসরি লুণ্ঠন” হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং একে “জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা” হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, টিএসএমসির সবচেয়ে উন্নত উৎপাদন ক্ষমতা ভাগ করে দিলে ‘সিলিকন শিল্ড’-এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে যাবে এবং তাইওয়ানের কৌশলগত নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়বে।

বর্তমানে তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচনা চলছে। তাইওয়ানের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক কমানোর চেষ্টা করছেন, যা বর্তমানে ২০ শতাংশে রয়েছে। তাইওয়ানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের দাবি তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও কঠিন করে তুলছে এবং জনগণের মধ্যে আমেরিকার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করছে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে টিএসএমসি যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফিনিক্সে (Phoenix) উন্নত চিপ তৈরির কারখানা তৈরিতে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। পরে তারা এই বিনিয়োগের পরিমাণ ১৬৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করে। তাইওয়ানের অনেক মানুষ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে তাদের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পখাতকে দুর্বল করতে চাইছে। তাইওয়ানের অর্থনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক আরিসা লিউ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ তাইওয়ানের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ এবং উৎপাদন ক্ষমতা সরিয়ে নেওয়া হলে, তাইওয়ানের নিজস্ব ইকোসিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়বে, যা তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলের অখণ্ডতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তাইওয়ানের চিপ শিল্পের সাফল্যের পেছনে রয়েছে সিলিকন ওয়েফার সরবরাহকারী থেকে শুরু করে সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক এবং পরিষেবা প্রদানকারীর মতো শিল্পখাতগুলোর উচ্চ ঘনত্ব। এটি একটি সম্পূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করেছে, যা সেমিকন্ডাক্টর তৈরির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *