আতঙ্ক! কিশোরদের বন্ধু এখন এআই, বাড়ছে মানসিক অবসাদ?

শিরোনাম: তরুণ প্রজন্মের বন্ধু কি তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? উদ্বেগে অভিভাবকরা।

বর্তমান ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি আমাদের জীবনযাত্রায় এনেছে বিপুল পরিবর্তন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)।

এই AI প্রযুক্তি এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করেছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর ব্যবহার বাড়ছে চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর-কিশোরীরা এখন বন্ধু, পরামর্শদাতা এবং মানসিক আশ্রয় হিসেবে AI-এর ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে।

কয়েক বছর আগেও যেখানে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পরীক্ষার হলে নকল করার প্রবণতা নিয়ে আলোচনা হতো, সেখানে এখন AI কিভাবে তাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে, সেই বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ক্যানসাসের কাইলা চেগে-র মতো অনেক কিশোরী এখন পোশাক নির্বাচন থেকে শুরু করে বন্ধুদের সাথে কথা বলা, এমনকি জন্মদিনের পরিকল্পনা করার মতো বিষয়গুলোতেও ChatGPT-এর সাহায্য নিচ্ছে। কাইলা মনে করে, AI ব্যবহারের ফলে তরুণ প্রজন্ম যেন “চিন্তা করা” থেকে দূরে থাকছে।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা, কমন সেন্স মিডিয়া-র করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি কিশোর-কিশোরী AI-এর সাহায্য নিচ্ছে, এবং তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নিয়মিতভাবে এটি ব্যবহার করে।

Character.AI বা Replika-র মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে ডিজিটাল বন্ধু হিসেবে, যেখানে ব্যবহারকারীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে পারে এবং আবেগপূর্ণ কথোপকথন করতে পারে।

তবে ChatGPT এবং Claude-এর মতো সাধারণ প্রশ্ন-উত্তর করার ওয়েবসাইটগুলোও একইভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রযুক্তি মানব সম্পর্কের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে দিতে পারে।

১৮ বছর বয়সী গনেশ নাইয়ারের মতে, “AI সবসময় উপলব্ধ থাকে।

এটি কখনো বিরক্ত হয় না, এবং কোনো বিচারও করে না।

AI-এর সাথে কথা বললে, আপনি সবসময় সঠিক এবং আকর্ষণীয়।” কিন্তু নাইয়ার এখন AI ব্যবহার করা কমিয়ে দিতে চান।

কারণ, তার এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা তাকে হতাশ করেছে।

বন্ধুটি একটি AI-এর সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করে, এমনকি তার প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদের বার্তাও সেই AI তৈরি করে দেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৩১ শতাংশ কিশোর-কিশোরী জানিয়েছে, AI-এর সাথে তাদের কথোপকথন বন্ধুদের সাথে কথা বলার মতোই আনন্দদায়ক।

এমনকি, ৩৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো নিয়ে বন্ধুদের পরিবর্তে AI-এর সাথে আলোচনা করে।

কমন সেন্স মিডিয়ার প্রধান গবেষক মাইকেল রব এই বিষয়টিকে উদ্বেগজনক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

তিনি মনে করেন, অভিভাবকদের, শিক্ষকদের এবং নীতিনির্ধারকদের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত।

কারণ, দ্রুত বর্ধনশীল এবং নিয়ন্ত্রণহীন AI প্রযুক্তি কিশোর-কিশোরীদের জীবনে স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মতোই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণদের মধ্যে AI-এর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা তাদের সামাজিক দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশে বাধা দিতে পারে।

মনোবিজ্ঞানী এবং ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলাইনা-র অধ্যাপক ইভা টেলজার মনে করেন, AI-এর প্রতি এই আসক্তি অভিভাবকদের ধারণার বাইরে চলে গেছে।

টেলজারের গবেষণা থেকে জানা যায়, আট বছর বয়স থেকেই শিশুরা এই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

অনেক কিশোর-কিশোরী তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করতে, এমনকি সঙ্গীর অভাব পূরণ করতেও AI-এর সাহায্য নিচ্ছে।

SpicyChat AI-এর মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলো, যা মূলত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তৈরি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।

অনেক কিশোর-কিশোরী জানিয়েছে, তারা গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে ইমেল বা বার্তা লেখার জন্য AI ব্যবহার করে।

টেলজার বলেন, “তাদের মধ্যে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে।

তারা মনে করে, AI-এর মতামত না পেলে তাদের কোনো আইডিয়া সঠিক নয়।

আর্কানসাসের ১৭ বছর বয়সী ব্রুস পেরির অভিজ্ঞতাও একই রকম।

তিনি ক্লাসের প্রবন্ধ লেখার জন্য AI-এর সাহায্য নেন।

তার মতে, AI দ্রুত তার ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে পারে।

পেরির আশঙ্কা, AI-এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে শিশুরা হয়তো বন্ধু তৈরি করা বা খেলাধুলার মতো বিষয়গুলো থেকে দূরে চলে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, AI-এর সমস্যাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ভিন্ন।

সামাজিক মাধ্যম আমাদের পরিচিতি এবং নতুন মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে, কিন্তু AI আমাদের “আসক্তির” চাহিদা পূরণ করে, যা আরও গভীর—আমাদের মানসিক সংযোগ এবং অনুভূতির চাহিদা।

বর্তমানে, বাংলাদেশেও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট-এর ব্যবহার ব্যাপক।

তাই, AI প্রযুক্তির এই প্রভাব থেকে বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীরাও ঝুঁকিমুক্ত নয়।

অভিভাবকদের সচেতনতা, সঠিক গাইডেন্স এবং এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *