থাইল্যান্ডে খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়ের ব্যবহার বাড়ছে, বাংলাদেশের জন্য কি কোনো সম্ভাবনা?
থাইল্যান্ড বর্তমানে খাদ্য হিসেবে পোকামাকড় উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়ের ব্যবহার বহু পুরনো। এই ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে তারা বাণিজ্যিকভাবে এই ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছে। শুধু তাই নয়, উন্নত বিশ্বে যেখানে খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়ের ব্যবহার এখনো সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি, সেখানে থাইল্যান্ড একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ইসান প্রদেশে সুয়াইমন চানতাজোন নামের এক নারী, যিনি ছোটবেলায় তার দাদার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় খাওয়ার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার দাদা কীভাবে পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করেছিলেন, সেই গল্প শুনে তিনি অনুপ্রাণিত হন। এরপর তিনি নিজে মাঠেঘাটে ঘুরে ক্রিকেট, বাঁশ কীট এবং বিটল পোকার মতো বিভিন্ন পোকামাকড় খুঁজে বের করতেন। বড় হয়ে তিনি যখন নিজের ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবেন, তখন একটি ঘটনার জন্ম হয়।
তানজানিয়ার একটি গেমিং লজে ভ্রমণের সময়, এক জার্মান পর্যটকের শরীরে একটি পোকামাকড় দেখে তিনি ভয় পেয়ে চিৎকার করেন। এই ঘটনা থেকেই তার মাথায় আসে একটি নতুন ধারণা। থাইল্যান্ডে ফিরে এসে তিনি ‘সিয়াম বাগস’ নামে একটি ক্রিকেট খামার তৈরি করেন।
বর্তমানে, তার খামারটি দেশটির খাদ্য হিসেবে পোকামাকড় শিল্পের একটি অংশ। পাত্তায়া শহরের বাইরে একটি শান্ত এলাকায় তার খামারটি অবস্থিত। এখানে প্রায় ২০,০০০-এর বেশি ক্রিকেট খামার রয়েছে। একটি বিমানের হ্যাঙ্গারের মতো বিশাল আকারের একটি গুদামে, তিনি ১৮টি স্থানীয় খামারের একটি সমবায় সমিতির সদস্য হিসেবে বছরে প্রায় সাত টন ক্রিকেট উৎপাদন করেন। এই ক্রিকেটের জীবনচক্র ৪৫ দিনের হয়ে থাকে এবং খাদ্য হিসেবে তারা শস্য, ভুট্টা ও চালের তুষ ব্যবহার করে।
সুয়াইমন চানতাজোন বলেন, ‘আমি যেন ক্রিকেটের মা।’
থাইল্যান্ডের গ্রামীণ সমাজে পোকামাকড় দীর্ঘদিন ধরে প্রোটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে, এই ঐতিহ্যবাহী চর্চা বর্তমানে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর ফলে থাইল্যান্ড খাদ্য হিসেবে পোকামাকড় উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে, ক্রিকেট ও অন্যান্য পোকামাকড়ের খামারগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে পোষা প্রাণীর খাদ্য সরবরাহ করে। এছাড়া, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টেও পোকামাকড় ব্যবহার করে খাবারের নতুনত্ব আনা হচ্ছে, যা তাদের মেনুকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে।
খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়কে পুষ্টিকর এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব। পোকামাকড়ে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফ্যাট এবং অন্যান্য উপাদান থাকে যা শরীরের জন্য উপকারী।
উদাহরণস্বরূপ, এদের শরীরে থাকা কাইটিন নামক তন্তু বিপাক ক্রিয়া এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
থাইল্যান্ডে ২০০টির বেশি প্রজাতির পোকামাকড় পাওয়া যায়, যা মেক্সিকোর পরেই দ্বিতীয় স্থানে। দেশটির উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পোকামাকড় খাওয়ার প্রচলন সবচেয়ে বেশি, যেখানে এগুলো মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানকার বাজারে বিভিন্ন ধরনের জীবিত ও শুকনো পোকামাকড় পাওয়া যায়, যেমন – ক্রিকেট, পিঁপড়া, মথ, এবং ঝিঁঝিঁ পোকা।
বাটারফ্লাই বাঁশ কীট, বিশাল আকারের জলজ পোকা, লাল পিঁপড়ার ডিম ইত্যাদি জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বর্তমানে, থাইল্যান্ডের ব্যাংককের ক্লোং তোই বাজারে খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়ের ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। এখানকার বিক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম ওনরুং বুনথুম। তিনি জানান, ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীরা তাদের প্রধান গ্রাহক, যারা তাদের রেস্টুরেন্টের জন্য জলজ পোকা কিনে নিয়ে যায়।
তবে, পোকামাকড়ের পুরো রূপটি দেখে অনেকেই খাবারটি খেতে দ্বিধা বোধ করেন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য উৎপাদকরা পোকামাকড়কে গুঁড়ো করে বিভিন্ন খাবারে মেশানোর চেষ্টা করছেন, যেমন – কোকো, রুটি এবং নুডলস। থাই ইনসেক্ট ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি থানাপুম মুয়াং-ইয়াম বলেন, ‘যদি পোকামাকড়কে গুঁড়ো করে ব্যবহার করা যায়, তাহলে মানুষের মধ্যে ভীতি কমে যাবে।’
বর্তমানে, ফ্রাইড ক্রিকেট এখনো খুব জনপ্রিয় এবং বিয়ারের সঙ্গে স্ন্যাকস হিসেবে এটি পরিবেশন করা হয়। কিছু রেস্তোরাঁ মাংসের পরিবর্তে পোকামাকড় ব্যবহার করে সাফল্য অর্জন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংককের বাউন্স বার্গার নামের একটি রেস্টুরেন্টে, বার্গারের মাংসের ১৫ শতাংশ তৈরি হয় ভাজা ক্রিকেট দিয়ে।
রেস্তোরাঁটির মালিক পুরিপাত থিয়াপাইরাত জানান, ‘অনেকেই বলেন তারা ক্রিকেটের স্বাদ পান না, কিন্তু বার্গারটি তাদের খুব পছন্দ হয়।’
আককি নামের একটি মিশেলিন-স্টার রেস্তোরাঁতেও পোকামাকড়ের ব্যবহার দেখা যায়, যেখানে শেফ সিটিকর্ন চানটপ বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের পদ তৈরি করেন।
পোকামাকড়ের বাণিজ্যিকীকরণের ফলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে থাইল্যান্ড তাদের ঐতিহ্য হারাতে পারে। তবে, অন্যরা মনে করেন এটি স্থানীয় কৃষকদের জন্য উপকারী হতে পারে, কারণ এর মাধ্যমে তারা শহরে না গিয়ে গ্রামে বসেই পোকামাকড় চাষ করে উপার্জন করতে পারবে।
খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়ের চাষ পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এটিকে টেকসই খাদ্য ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচনা করে। পোকামাকড় চাষে জমির ব্যবহার, জল ও শক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কম হয়। এছাড়া, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণও কম হয় এবং বর্জ্যও খুব সামান্য উৎপন্ন হয়।
এমনকি, ক্রিকেটের বিষ্ঠা, যা নাইট্রোজেনে ভরপুর, তা সবজির জন্য চমৎকার সার হিসেবে কাজ করে।
থাইল্যান্ড ইতিমধ্যে এই ক্ষেত্রে বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেছে। এখানকার বিজ্ঞানীরা FAO-কে ক্রিকেট চাষের নির্দেশিকা তৈরিতে সহায়তা করেছেন। খামারের স্বাস্থ্যবিধি, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্য সুরক্ষার ওপর কঠোর বিধিনিষেধের কারণে দেশটি এশিয়াতে খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়ের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।
তবে, ইউরোপের বাজারে এখনো এই ব্যবসার প্রসার ঘটেনি, কারণ সেখানে পোকামাকড় খাওয়ার বিষয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিধা রয়েছে এবং সরকারও প্রচলিত কৃষির তুলনায় এই শিল্পকে কম সমর্থন করে। বর্তমানে, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলো পোষা প্রাণীর খাদ্য বাজারের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে, যেখানে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই লার্ভার চাহিদা বাড়ছে।
বাংলাদেশেও কি এমন সম্ভাবনা রয়েছে? আমাদের দেশেও খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়ের ব্যবহার নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা থাইল্যান্ডের এই মডেল অনুসরণ করে স্থানীয় প্রেক্ষাপটে একটি উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক