তিব্বতের চিঠি: এক দুর্লভ যাত্রাপথ, নিষিদ্ধ হৃদয়ে

চীনের কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকা তিব্বতের হৃদয়ে এক ভ্রমণ।

চীন সরকারের কড়া নজরদারির মধ্যে থাকা তিব্বতের ভেতরে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার খুব সীমিত। সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা সিএনএন-এর একজন সাংবাদিক তিব্বত পরিদর্শনের সুযোগ পান। এই সফরকালে তিনি সেখানকার রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা, চীনা সরকারের নিয়ন্ত্রণ এবং স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর এর প্রভাব সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন।

বিমানের জানালা দিয়ে তুষারাবৃত পর্বতমালা দেখতে দেখতে ওই সাংবাদিকের মনে হয়েছিল, তিনি যেন এক অসাধারণ সুন্দর এবং রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রবেশ করছেন। বিমানবন্দরে অবতরণের পরেই ছবি তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, যা চীনের কঠোর নিয়ন্ত্রণের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।

ঐতিহাসিকভাবে, তিব্বত একসময় চীনের থেকে আলাদা ছিল। তিব্বতিদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় পরিচয় রয়েছে, যা হান চাইনিজদের থেকে ভিন্ন। ১৯৫০ সালে চীন তিব্বতকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এর কয়েক বছর পর, ১৯৫৯ সালে তিব্বতের ধর্মগুরু ১৪তম দালাইলামা চীনের শাসন থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর থেকে চীন তিব্বতের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করে এবং সেখানকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে দুর্বল করার চেষ্টা করে।

সাংবাদিকের এই সফরে তিব্বতের রাজধানী লাসাতে আধুনিক উন্নয়নের চিত্র দেখা যায়। বিমানবন্দরের বাইরে মহাসড়ক এবং নতুন নির্মিত ভবনগুলো চীনের ব্যাপক বিনিয়োগের প্রমাণ। তবে, একইসঙ্গে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান এখনো তুলনামূলকভাবে অনেক নিচে।

পর্যটকদের জন্য লাসা একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। বিশেষ করে, চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে আসা পর্যটকদের আনাগোনা এখানে চোখে পড়ার মতো। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ৬ কোটি ৪০ লক্ষ পর্যটক তিব্বত ভ্রমণ করেছেন।

পর্যটকদের পাশাপাশি, তিব্বতের পবিত্র স্থানগুলোতে ধর্মপ্রাণ মানুষের আনাগোনাও দেখা যায়। লাসার বারখোর স্ট্রিটে তিব্বতি তীর্থযাত্রীদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে দেখা যায়, যেখানে তারা প্রার্থনা চক্র ঘোরায় এবং মন্দিরের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে।

পর্যটকদের সুবিধার জন্য এখানে আধুনিক সব সুবিধা রয়েছে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে কেনাকাটার বিভিন্ন দোকান—সবকিছুই বিদ্যমান। তবে, এখানকার জীবনযাত্রায় চীনের সংস্কৃতির প্রভাবও সুস্পষ্ট। রাস্তায় চীনা রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ে, যা প্রতিবেশী প্রদেশ থেকে আসা হান চাইনিজদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে।

পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হলো পোতালা প্রাসাদ, যা একসময় দালাইলামাদের শীতকালীন আবাসস্থল ছিল। বর্তমানে দালাইলামা ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। চীনের সরকার দালাইলামাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে। দালাইলামা তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে চীনের অনুমোদন চাননি, যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

তিব্বতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত নিংচি শহরে বুলেট ট্রেনের মাধ্যমে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও ছিল সাংবাদিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই রেলপথটি তিব্বতের দুর্গম অঞ্চলকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করার একটি প্রতীক। এখানে একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে তিব্বতি শিশুদের চীনা ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়, যা স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ভাষার ওপর প্রভাব ফেলছে বলে অনেকে মনে করেন।

চীন-ভারত সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিরতা এবং দালাইলামার উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের কারণে তিব্বতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। দালাইলামার প্রয়াণের পর তিব্বতের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা চলছে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *