টাইটানিকের ডিজিটাল প্রতিরূপ: ধ্বংসাবশেষের গভীরে অনুসন্ধানের নতুন দিগন্ত।
এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে, উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার ছিল এক বিশাল ঘটনা। এরপর থেকে, এই ঐতিহাসিক জাহাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ আজও বিদ্যমান।
সম্প্রতি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে টাইটানিকের একটি বিস্তারিত ডিজিটাল মডেল তৈরি করা হয়েছে, যা অনুসন্ধানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
এই ডিজিটাল মডেল তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক থ্রিডি স্ক্যানিং প্রযুক্তি। গভীর সমুদ্রের এই বিশাল কাজটি করেছে ‘ম্যাгелান’ নামক একটি কোম্পানি।
তারা দুটি বিশেষ রোবট, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রোমিও’ এবং ‘জুলিয়েট’, সেগুলোকে সমুদ্রের গভীরে পাঠিয়েছিল। এই রোবটগুলো ৭ লক্ষ ১৫ হাজারের বেশি ছবি তুলেছিল এবং কয়েক মিলিয়ন লেজার পরিমাপের মাধ্যমে ডেটা সংগ্রহ করে।
এই বিশাল ডেটা থেকে তৈরি হয়েছে টাইটানিকের ত্রিমাত্রিক প্রতিরূপ, যা ১৬ টেরাবাইট ডেটা ধারণ করে। এই পরিমাণ ডেটা প্রায় ৬০ লক্ষ ই-বুকের সমান।
এই ডিজিটাল মডেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর বিস্তারিত চিত্র। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের এমন সূক্ষ্ম চিত্র আগে কখনো দেখা যায়নি।
বিখ্যাত টাইটানিক বিশেষজ্ঞ পার্কস স্টিফেনসন, যিনি বেশ কয়েকবার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন, এই ডিজিটাল মডেল দেখে অভিভূত হয়েছেন।
তিনি জানিয়েছেন, সাবমার্সিবলের ( ডুবোজাহাজ) মাধ্যমে জাহাজের ভেতরের খুব সামান্য অংশই দেখা যেত। কিন্তু এই ডিজিটাল মডেলের মাধ্যমে তিনি জাহাজের প্রতিটি কোণা, এমনকি ইঞ্জিনের কন্ট্রোল এবং ধ্বংসাবশেষের প্রতিটি অংশ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন।
ডিজিটাল মডেলের মাধ্যমে টাইটানিক সম্পর্কে নতুন অনেক তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, জাহাজের পেছনের অংশ কিভাবে ভেঙে গিয়েছিল, তা এই মডেলের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে।
আগে এটি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে অনেক মতভেদ ছিল। এছাড়াও, মডেলটিতে দেখা গেছে, বাষ্পীয় ইঞ্জিন রুমের একটি ভালভ খোলা ছিল, যা সম্ভবত জাহাজটি ডুবে যাওয়ার সময় জরুরি জেনারেটর চালু রাখার জন্য খোলা রাখা হয়েছিল।
এই প্রযুক্তি শুধু টাইটানিকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি প্রত্নতত্ত্ব এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণেও এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান, যেমন – ইতালির পম্পেই নগরী, ইউক্রেনের ক্ষতিগ্রস্ত কিছু স্থান এবং নাইজেরিয়ার ওশুন-ওশোগবো পবিত্র বনভূমি-র মতো স্থানগুলোরও ডিজিটাল মডেল তৈরি করা হচ্ছে।
এই মডেলগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ অথবা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্থানগুলোকে সংরক্ষণে সাহায্য করবে।
এই ডিজিটাল মডেলগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর ফলে, সাধারণ মানুষও টাইটানিকসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে এবং সেগুলোর ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হতে পারবে।
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক, এবং তাদের কারণে এখানকার পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
ডিজিটাল মডেলের মাধ্যমে এখন সবাই এই ঐতিহাসিক স্থানগুলো আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারবে, যা ধ্বংসাবশেষের উপর মানুষের সরাসরি প্রভাব কমিয়ে দেবে।
টাইটানিকের ডিজিটাল প্রতিরূপ তৈরির এই প্রকল্পটি একদিকে যেমন প্রযুক্তির অগ্রগতি, তেমনিভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এটি ইতিহাস প্রেমীদের জন্য এক দারুণ সুযোগ, যা তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করবে এবং একই সঙ্গে ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণে সহায়তা করবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।