রহস্য! পরমাণু প্রকল্পে লর্ডসভার সদস্যের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন!

যুক্তরাজ্যের একজন কনজারভেটিভ দলের প্রভাবশালী সদস্য, অলিভিয়া ব্লুমফিল্ডের বিরুদ্ধে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। অভিযোগ উঠেছে, তিনি একটি কানাডীয় নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

কোম্পানিটি হলো ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’, যারা যুক্তরাজ্যে পরবর্তী প্রজন্মের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। ব্লুমফিল্ডের এই সমর্থন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কারণ তিনি বিভিন্ন সময়ে এই কোম্পানির হয়ে কাজ করেছেন, উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন এবং শেয়ার অপশনও পেয়েছেন।

জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে ব্লুমফিল্ড এই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বৈঠকের ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি বরিস জনসনের সরকারে হুইপ (দলীয় শৃঙ্খলারক্ষক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময়ও তিনি আরও দুইজন প্রভাবশালী সদস্যকে কোম্পানির উপদেষ্টা বোর্ডে যোগ দিতে সহায়তা করেন।

ব্লুমফিল্ড যখন সরকারি পদ থেকে অবসর নেন, তখন তাকে শেয়ার অপশন দেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এই শেয়ারের মূল্য বিশাল হতে পারে, যা চলতি বছরে কোম্পানিটির শেয়ার বাজারে আসার পর প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার সমান) হতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ব্লুমফিল্ডের কাজগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নীতির পরিপন্থী হতে পারে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক এবং পরবর্তীতে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। তাদের মতে, হাউস অফ লর্ডসের নিয়ম অনুযায়ী, এমন কাজ করা যায় না।

ব্লুমফিল্ড অবশ্য তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তিনি সবসময় নিয়ম মেনেই কাজ করেছেন এবং কোনো প্রকার বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করেননি।

ব্লুমফিল্ড ২০১৬ সালে ডেভিড ক্যামেরনের মনোনয়নে হাউস অফ লর্ডসে যোগ দেন। এর আগে তিনি ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কনজারভেটিভ পার্টির তহবিল সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন। হাউস অফ লর্ডসে যোগ দেওয়ার পর তিনি নিউক্লিয়ার এনার্জি নিয়ে আগ্রহী হন এবং এই বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য একটি ফেলোশিপও করেন।

জানা যায়, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে ব্লুমফিল্ড ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’র প্রতি সমর্থন জানানো শুরু করেন। তিনি কোম্পানির কর্মকর্তাদের নিয়ে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সময়ে তিনি জানান, ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’র সঙ্গে তার কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই।

তবে সরকারি কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, ব্লুমফিল্ড তাদের ‘আশ্চর্য’ করে এই বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। তারা আরও জানান, ব্লুমফিল্ড কোম্পানিটির স্বার্থের পক্ষে ওকালতি করছেন এবং এর আগে তিনি ওয়েলসের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন মন্ত্রীর সঙ্গেও কোম্পানিটির কর্মকর্তাদের পরিচয় করিয়ে দেন।

এর দুই মাস পর, ২০১৮ সালের জুনে ব্লুমফিল্ড ওয়েলস অফিসের একজন জুনিয়র মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখানে ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’র পক্ষ থেকে ওয়েলসে তাদের রিঅ্যাক্টর স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ব্লুমফিল্ড এই বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং কোম্পানিটির তৈরি করা কিছু নথিও তিনি ওয়েলস অফিসে পাঠিয়েছিলেন।

পরে, একই মাসে তাকে কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং শেয়ার অপশন দেওয়া হয়। ব্লুমফিল্ডের দাবি, তিনি কোনো বেতন না নিয়ে শেয়ার অপশন নিয়েছিলেন, কারণ তখন কোম্পানিটি লাভজনক ছিল না। হাউস অফ লর্ডসের সদস্যদের বেতন নেওয়ার বিনিময়ে কোনো পরিষেবা দেওয়ার অনুমতি নেই।

ব্লুমফিল্ড আরও বলেছেন, তিনি মিটিংগুলো আয়োজনের সময় ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’র সঙ্গে কোনো আর্থিক লেনদেন করেননি। তাই তিনি লর্ডসের কোনো নিয়ম ভঙ্গ করেননি। তবে প্রশ্ন উঠেছে, জুনের মিটিংয়ের সময় তিনি কোম্পানির সঙ্গে কোনো বাণিজ্যিক চুক্তিতে পৌঁছেছিলেন কিনা।

এই বিষয়ে ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’ এবং ব্লুমফিল্ড কেউই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

২০১৯ সালের জুলাই মাসে ব্লুমফিল্ডকে জনসনের সরকারে হুইপ হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এই সময়ে তার দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের হয়ে বিতর্কে অংশ নেওয়া। তিনি জানান, হুইপ হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় তিনি শেয়ার অপশন এবং ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’র উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।

তবে তিনি মন্ত্রী থাকাকালীনও কোম্পানিটিকে সমর্থন করে গেছেন।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্লুমফিল্ডের সহকর্মী ছিলেন ইয়ান ডানকান, যিনি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ব্লুমফিল্ড জানিয়েছেন, উপদেষ্টা বোর্ড থেকে পদত্যাগ করার পর তিনি লর্ড ডানকান এবং জন ব্রাউনের (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের সাবেক প্রধান নির্বাহী) মতো ব্যক্তিদের সেখানে নিয়োগ করেন।

২০২১ সালের এপ্রিলে তৎকালীন জ্বালানিমন্ত্রী অ্যান-মারি ট্রেভেলিয়ান ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’র প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে একটি বৈঠক করেন, যা ব্লুমফিল্ডের সুপারিশে হয়েছিল। বৈঠকের পর জানা যায়, কোম্পানিটি সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা চেয়েছিল। ব্লুমফিল্ডের দাবি, তিনি একা নন, আরও অনেককে এই মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন।

২০২২ সালের এপ্রিলে ব্লুমফিল্ড ছোট আকারের মডুলার রিঅ্যাক্টর বিষয়ক একটি সংসদীয় গ্রুপের বৈঠকে যোগ দেন, যেখানে ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’ একটি উপস্থাপনা দেয়। ব্লুমফিল্ড জানান, তিনি আগে এই কোম্পানির উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য ছিলেন এবং ২০১৮ সালে তিনি কিভাবে একজন মন্ত্রীর সঙ্গে কোম্পানিটির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কেও জানান।

২০২৩ সালের আগস্টে, সরকার ছাড়ার তিন মাসের মধ্যেই ব্লুমফিল্ডকে আবার ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’তে নিয়োগ দেওয়া হয়। এবার তাকে শেয়ার অপশন দেওয়া হয়, যা ভবিষ্যৎ তহবিল সংগ্রহ এবং উপযুক্ত কর্মী নিয়োগের জন্য দেওয়া হয়েছিল।

দুর্নীতি বিষয়ক সংস্থা ‘স্পটলাইট অন কারাপশন’-এর পরিচালক সুসান হ্যালি বলেন, ব্লুমফিল্ড একজন মন্ত্রী হিসেবে কোম্পানির জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পরে আবার তাদের সঙ্গেই কাজ করা শুরু করেছেন, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।

ব্লুমফিল্ড জানিয়েছেন, তিনি সব নিয়ম মেনেই কাজ করেছেন এবং প্রাক্তন মন্ত্রীদের কাজের ক্ষেত্রে অনুমোদনের জন্য গঠিত ‘অ্যাডভাইসরি কমিটি অন বিজনেস অ্যাপয়েন্টমেন্টস (একোবা)’ থেকেও তিনি অনুমোদন নিয়েছিলেন। তবে তিনি একোবাকে জানাননি যে তিনি মন্ত্রী থাকাকালীন ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’র উপদেষ্টা বোর্ডে ছিলেন এবং সংসদীয় গ্রুপের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন।

‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’র একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তারা আশা করেন তাদের কর্মী ও উপদেষ্টারা সব নিয়মকানুন ও নৈতিকতা মেনে চলবেন। ব্লুমফিল্ড তাদের জানিয়েছেন, তিনি সবসময় লর্ডসের নিয়ম মেনেই কাজ করেছেন।

বর্তমানে ব্লুমফিল্ড হাউস অফ লর্ডসে উন্নত মডুলার রিঅ্যাক্টর নিয়ে কথা বলেন, যা ‘টেরেস্ট্রিয়াল এনার্জি’ তৈরি করছে।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *