জাপানের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ কিমোনো। এই পোশাক তৈরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো নিশিজিনোরি বুনন, যা কয়েক শতাব্দী ধরে কিয়োটো শহরে চলে আসছে।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে, এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প আজ এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় জাপানে কিমোনোর চাহিদা কমে যাওয়ায়, এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।
কিয়োটোর নিশিজিন জেলায় অবস্থিত ফুকুওকা উইভিং-এর চতুর্থ প্রজন্মের শিল্পী হিরোনোরি ফুকুওকা, এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তিনি চান তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে।
তাই, তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence বা AI) সাহায্য নিচ্ছেন। ফুকুওকা মনে করেন, “আমি চাই আমার বাবার রেখে যাওয়া ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ধরে রাখতে।”
ঐতিহ্য আর প্রযুক্তির এই যুগলবন্দী তৈরি হয়েছে সনি কম্পিউটার সায়েন্স ল্যাবরেটরিজের (Sony CSL) সহায়তায়। এই প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য হলো, এআই-এর মাধ্যমে নিশিজিনোরি বুনন শৈলীর নকশা তৈরি করা।
এআই ডিজাইন তৈরি করলেও, বুননের আসল কাজটি করেন দক্ষ কারিগররা।
এই বিষয়ে সনি সিএসএল-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জুন রিকিমোতো বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, মানুষের জীবন তখনই উন্নত হয় যখন নতুন উদ্ভাবন এবং পুরাতন ঐতিহ্যের মধ্যে একটি সমন্বয় ঘটে।” এআই-কে কাজে লাগিয়ে তারা কিভাবে ঐতিহ্যকে আধুনিকতার সাথে যুক্ত করতে পারে, সে বিষয়ে গবেষণা করছেন।
উদাহরণস্বরূপ, এআই ইতোমধ্যে নিশিজিনোরির পুরনো নকশাগুলো বিশ্লেষণ করে নতুন কিছু ডিজাইন তৈরি করেছে।
এআই-এর কাজ হলো, ডিজাইন তৈরি করা। এরপর, সেই ডিজাইন অনুযায়ী কাপড়ে বুনন করেন কারিগররা। এআই-এর তৈরি করা কিছু নকশা বেশ আকর্ষণীয় হলেও, ফুকুওকা মনে করেন, এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
তবে, এআই-এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি খুব দ্রুত বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন তৈরি করতে পারে।
নিশিজিনোরি কিমোনোর দাম অনেক সময় ৬,৭০০ মার্কিন ডলার (প্রায় ৭ লক্ষ টাকার বেশি) পর্যন্ত হতে পারে। বর্তমানে জাপানে কিমোনোর চাহিদা কমে যাওয়ায়, অনেকে বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া এটি কেনেন না।
এই পোশাক পরা বেশ কঠিন এবং অনেক সময় পেশাদার সাহায্য প্রয়োজন হয়, যা এর জনপ্রিয়তা কমাতে সাহায্য করেছে।
সনি সিএসএল-এর সহযোগী গবেষক ড. লানা সিনাপায়েন মনে করেন, এআই-কে সৃজনশীল এবং মজাদার কাজে ব্যবহার করা উচিত, যেখানে মানুষের মনোযোগ কম দিতে হয়। তার মতে, এআই-কে নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা উচিত।
ডিজিটাল প্রযুক্তি নিশিজিনোরির সব রঙের সূক্ষ্মতা সরাসরি ফুটিয়ে তুলতে পারে না, তবে এআই সেই কাজটি ভালোভাবে করতে পারে। এছাড়াও, এআই একজন শিল্পীর তৈরি করা নকশার ভুলগুলো চিহ্নিত করতে পারে এবং সেগুলোকে ঠিক করতে সাহায্য করে।
বর্তমানে, এআই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন – কারখানা, অফিস, স্কুল এবং বাড়িতে। এটি মানুষের চেয়ে দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারে। তবে, জাপানে পরিবর্তনের প্রতি মানুষের কিছুটা দ্বিধা রয়েছে।
তারা ধীরে ধীরে এবং সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে।
ফিনল্যান্ডের গবেষক হেনরিকা ভার্তিয়াইনেন এবং মাতি টেড্রে তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, “কম্পিউটার মানুষের একঘেয়ে কাজগুলো গ্রহণ করার ফলে, মানুষের কল্পনা ও সৃজনশীলতার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে।”
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রশিল্প যেমন জামদানি, মসলিন, এবং নকশী কাঁথা—এগুলোর ক্ষেত্রেও এআই-এর ব্যবহার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
ঐতিহ্য আর প্রযুক্তির মেলবন্ধনে আমাদের দেশের কারুশিল্পীরাও উপকৃত হতে পারেন, যা তাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে সাহায্য করবে।
তথ্য সূত্র: