ট্রান্সিলভেনিয়ার গোপন রহস্য: দীর্ঘ ও সুখী জীবনের চাবিকাঠি?
পূর্ব ইউরোপের একটি সুপরিচিত অঞ্চল হলো ট্রান্সিলভেনিয়া, যা রুমানিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত। এখানকার কারাক্সনিফলভা নামক একটি গ্রামে, যুগ যুগ ধরে বসবাস করা সেকেল সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রা হয়তো আমাদের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ ও সুখী জীবনের রহস্য।
কারাক্সনিফলভার বাসিন্দারা মূলত সেকেল সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা প্রায় এক হাজার বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন। হাঙ্গেরীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা একটি বিশেষ ধরনের ভূমি-মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত, যা ‘কোজবির্তোকোসাগ’ নামে পরিচিত। এটি একটি সম্মিলিত ভূমি ব্যবস্থা, যেখানে গ্রামের সবাই মিলেমিশে তাদের জমি, বন ও চারণভূমি ব্যবহার করে।
এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গ্রামের মানুষেরা শীতকালে প্রয়োজনীয় জ্বালানি কাঠ থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।
কোজবির্তোকোসাগ-এর ধারণাটি এসেছে বহু পুরোনো ঐতিহ্য থেকে, যা এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। স্থানীয় নেতা ওরবান চাবার দূরদৃষ্টির কারণে এই ব্যবস্থা আজও টিকে আছে।
কমিউনিস্ট শাসনের সময় এই ঐতিহ্য বিলুপ্ত করার চেষ্টা করা হলেও, ১৯৮৯ সালে কমিউনিজম পতনের পর গ্রামবাসী আবার তাদের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনে। ওরবান চাবা তাঁর পুরনো কাগজপত্র সংগ্রহ করে এই কমিউনিটির ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন।
ট্রান্সিলভেনিয়ার গ্রামগুলো যেন প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি। এখানকার বাড়িগুলো লাল টালির ছাউনি দিয়ে তৈরি, যা এই অঞ্চলের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গ্রামের প্রবেশপথে দেখা যায় ‘সেকেল গেট’, যা কাঠের কারুকার্যখচিত এক বিশেষ ধরনের প্রবেশদ্বার।
এখানকার মানুষজন আজও তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছেন। প্রতি বছর এখানে ঐতিহ্যবাহী ‘শিশু বিবাহ’-এর আয়োজন করা হয়, যেখানে স্থানীয় ছেলে ও মেয়েরা বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়। এছাড়াও, এখানকার লোকেরা বিভিন্ন উৎসব পালন করে, যেমন— ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ও পানীয় তৈরি করা হয়।
এই অঞ্চলের মানুষেরা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখে। বনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণীর প্রতি তাঁদের বিশেষ যত্ন রয়েছে।
এখানকার জঙ্গলে ভালুক, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বসবাস রয়েছে। স্থানীয়রা বন থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে এবং বনভূমিকে রক্ষা করে।
তবে, আধুনিকায়নের যুগে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখানকার তরুণ প্রজন্মের অনেকেই উন্নত জীবনের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতকালে তাপমাত্রা বাড়ছে, যা এখানকার কৃষিকাজের জন্য হুমকি স্বরূপ। এছাড়া, রুমানিয়ার জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে।
এইসব পরিবর্তনের মাঝেও, ওরবান চাবার নেতৃত্বে কোজবির্তোকোসাগ-এর সদস্যরা তাঁদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিজেদের জীবনকে সুন্দরভাবে অতিবাহিত করছেন। তাঁরা তাঁদের পরিবার, সমাজ ও পরিবেশকে রক্ষার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ট্রান্সিলভেনিয়ার এই গ্রামগুলো যেন এক একটি জীবন্ত পাঠশালা, যা আমাদের শেখায় কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একটি সুখী জীবন যাপন করা যায়।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক