যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইন প্রয়োগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই পদক্ষেপ অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও কঠোর করে তুলছে, যা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সম্প্রতি, ‘ইমিগ্রেশনওএস’ নামে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে, যা অভিবাসন কর্মকর্তাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।
এই নতুন প্রযুক্তির মূল উদ্দেশ্য হল, অভিবাসন প্রত্যাশীদের শনাক্ত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। কর্মকর্তারা বলছেন, এই এআই প্রযুক্তি সম্ভাব্য আইন লঙ্ঘনের ঘটনা চিহ্নিত করতে, গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলি চিহ্নিত করতে এবং কর্মকর্তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে সহায়তা করবে।
এপ্রিল মাসে ফিনিক্স-এ অনুষ্ঠিত বর্ডার সিকিউরিটি এক্সপো-তে ভারপ্রাপ্ত ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) পরিচালক টড লিয়নস এই প্রক্রিয়াকে ‘অ্যামাজনের ডেলিভারি রুটের মতো, তবে মানুষ সহ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের (ডিএইচএস) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘ইমিগ্রেশনওএস’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এজেন্টরা অভিযান অনুমোদন করতে পারবে, গ্রেফতার করতে পারবে, আইনি কাগজপত্র তৈরি করতে পারবে এবং দ্রুত ডিটেনশন ও বিতাড়নের ব্যবস্থা করতে পারবে।
মূলত, এই সিস্টেমটি তথ্যের ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের কাজ করার পদ্ধতিকে নতুনভাবে সাজাবে।
যদিও এর আগে অভিবাসন সংক্রান্ত কাজে কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তবে এই প্রকল্পের পরিধি নজিরবিহীন। এই সিস্টেমে সন্দেহজনক কার্যকলাপের রিপোর্ট এবং ব্যাংক সিক্রেসি অ্যাক্টের অধীনে চিহ্নিত আর্থিক লেনদেনের মতো অ-অভিবাসন ডেটা উৎসও ব্যবহার করা হবে।
সাধারণত সন্ত্রাস দমন বা অর্থ পাচার বিরোধী মামলায় ব্যবহৃত এই সরঞ্জামগুলো এখন পরিচয় জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি থেকে শুরু করে অনুমোদন ছাড়া কাজ করা শ্রমিকদের চিহ্নিত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা এই ধরনের স্বচ্ছতাহীন এআই-এর ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এতে পক্ষপাতিত্ব, অতি-নিয়ন্ত্রণ এবং মানবিক তত্ত্বাবধানের অভাব দেখা দিতে পারে।
আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের ডেটা বিজ্ঞানী স্টিভেন হাবার্ড বলেন, ‘আগে এআই সরঞ্জামগুলো মূলত কর্মদক্ষতা বাড়াতে ব্যবহৃত হতো, যেমন কোনো মামলার পর্যালোচনা করা বা মুখের ছবি শনাক্ত করতে সহায়তা করা।
তবে নতুন সিস্টেমগুলো কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়।’
অন্যদিকে, বাইডেন প্রশাসন ডিএইচএস-এর এআই ব্যবহারের বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে শুরু করেছে। তারা এআই-এর ব্যবহার সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, আইডি যাচাইকরণ, জালিয়াতি সনাক্তকরণ, ডিটেনশনের বিকল্প এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য চ্যাটবটের মতো ক্ষেত্রে এআই সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পের অগ্রগতিতে সাহায্য করছে ‘পালাঙ্কির’। এই বৃহৎ সরকারি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩১২ কোটি টাকা) দিয়েছে আইসিই, ‘ইমিগ্রেশনওএস’ তৈরি করার জন্য।
সমালোচকরা বলছেন, এই সিস্টেম শুধু তথ্য সংগ্রহই করবে না, বরং এটি প্রয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোকেও প্রভাবিত করবে। যা কর্তৃপক্ষের তদারকি এবং জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
পালাঙ্কিরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এআই মানুষের কাজকে প্রতিস্থাপন না করে, বরং তাদের কর্মক্ষমতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে আরও উন্নত করতে ব্যবহার করা উচিত। তাদের মতে, ডেটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা এবং নাগরিক অধিকারের মৌলিক নীতিগুলো রক্ষা করা অপরিহার্য।
ট্রাম্প প্রশাসনের একজন সাবেক কর্মকর্তা সিএনএনকে জানান, ‘ইমিগ্রেশনওএস’ প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। তিনি আরও বলেন, নতুন প্ল্যাটফর্মটি অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবা (আইআরএস) এবং আদমশুমারির ডেটা ব্যবহার করবে।
এর মাধ্যমে এজেন্টরা সরাসরি অভিযান পরিচালনা করতে, গ্রেফতার করতে, আইনি কাগজপত্র তৈরি করতে এবং বিতাড়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।
সাবেক ওই কর্মকর্তা আইসিই-এর পালান্তিরের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘পুরো তথ্য প্রযুক্তি কাঠামো এখন পালান্তিরের সরঞ্জামের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।’
অন্যদিকে, নতুন ট্রাম্প-যুগের নির্দেশনার অধীনে ‘ইমিগ্রেশনওএস’ সদর দফতরের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্যও সরাসরি ব্যবহারযোগ্য হবে।
হাবার্ড সতর্ক করে বলেন, মুখের ছবি শনাক্তকরণ বা নজরদারির দিকে মনোযোগ দেওয়া হলেও, আসল প্রভাব সম্ভবত আরও গভীরে—স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কারা লক্ষ্যবস্তু হবে, আটক হবে বা বিতাড়িত হবে, সেই বিষয়গুলোতে পড়বে।
সাবেক ভারপ্রাপ্ত আইসিই পরিচালক জন স্যান্ডওয়েগ বলেন, বিতর্কের বিষয় হলো, এআই-এর উপযোগিতা নয়, বরং এটি কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘এই সরঞ্জামগুলো ভালো বা খারাপ—উভয় কাজেই ব্যবহার করা যেতে পারে।’
তথ্যসূত্র: সিএনএন