যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনের অনুকরণে তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন যা দেশটির মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। খবরটি প্রকাশ করেছে সিএনএন।
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন যা আগে আমেরিকায় দেখা যায়নি। তবে চীন, রাশিয়া এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত অর্থনীতিতে এর নজির রয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করতে চাইছেন।
বিষয়টি সম্ভবত আরও জটিল হতে চলেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো:
- যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরো (Bureau of Labor Statistics – BLS) কর্তৃক প্রকাশিত অর্থনৈতিক তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ট্রাম্প।
- বিএলএস-এর প্রকাশিত তথ্যের সমালোচনা করে আসা একজন অর্থনীতিবিদকে তিনি সমর্থন করেছেন।
- চীনের ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’-এর মডেলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির এই পরিবর্তনের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
আসলে, হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে গণমাধ্যম কৌশল হিসেবে এমন অনেক কিছুই করা হচ্ছে। এর পেছনের মূল উদ্দেশ্য হলো, অর্থনৈতিক তথ্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিএলএস-এর তথ্য নিয়ে ট্রাম্পের সন্দেহ প্রকাশ।
এই প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের পছন্দের কেউ যদি অর্থনৈতিক চিত্রকে আরও উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপন করতে চান, তবে তা করা কঠিন হবে। কারণ, এই বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এক ধরনের পেশাদারিত্ব রয়েছে।
তবে, সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, সরকারি এই সংস্থার বিরুদ্ধেই জনসমক্ষে সমালোচনা করা। এমনকি, এমন একজন অর্থনীতিবিদকে সামনে আনা হয়েছে যিনি কিনা এই সংস্থার কাজকর্মের সমালোচনা করে এসেছেন।
বিগত কয়েকদিনে এমন আলোচনা বেশ উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। যদিও বিএলএস-এর প্রক্রিয়া যে একেবারে নির্ভুল, তা নয়। তারপরও, প্রায় ৩ কোটি ডলারের বিশাল মার্কিন অর্থনীতিকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণে রাখার এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
অর্থনীতিবিদ অ্যারন সোজারনারের মতে, “এই ডেটাগুলো গোপন করা অনেকটা আমাদের চোখ উপড়ে ফেলার মতো। এর ফলে আমরা আমাদের চারপাশের পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি এবং ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছি।”
বিষয়টি নিছক কোনো তাত্ত্বিক আলোচনা নয়। এর বাস্তব উদাহরণও রয়েছে। ২০০৭ সালে, আর্জেন্টিনার সরকার তাদের মূল্যস্ফীতি বিষয়ক তথ্য প্রকাশ করার দায়িত্বে থাকা পরিসংখ্যানবিদকে বরখাস্ত করে। কারণ, তিনি সঠিকভাবে বলেছিলেন যে, ভোক্তামূল্যের সূচক দ্রুত বাড়বে। এর ফলস্বরূপ, বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে আর্জেন্টাইন বন্ড থেকে তাদের অর্থ তুলে নেয়। ফলে, দেশটির ঋণের সুদহার বেড়ে যায়।
যদিও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে তেমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, তবে ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যখন আগস্ট মাসের কর্মসংস্থান বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে, তখন ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, সেদিকে সবার নজর থাকবে। যদি ইতিবাচক প্রতিবেদন আসে, তাহলে বামপন্থীরা প্রশ্ন তুলবেন, সংস্থাটি প্রেসিডেন্টের প্রতি অনুগত হয়ে কাজ করছে কিনা। আবার, খারাপ ফল আসলে ডানপন্থীরা বলবেন, ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে।
এখানে চীনের মডেলের একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ট্রাম্পের এই অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে চীনের ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’-এর মিল রয়েছে। এই ব্যবস্থায়, সরকার সরাসরি কোনো ব্যবসার মালিক না হয়েও, ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক কলামিস্টের মতে, একসময় ধারণা করা হতো, চীন উদারনীতি গ্রহণ করলে দেশটির অর্থনীতি আমেরিকার মতো হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার পুঁজিবাদ চীনের মতো হতে শুরু করেছে। অবশ্যই, যুক্তরাষ্ট্র এখনো চীন কিংবা রাশিয়ার মতো ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে’র পথে সেভাবে হাঁটেনি। তবে, মুক্তবাজার অর্থনীতির যে ধারণা একসময় যুক্তরাষ্ট্রে ছিল, সেখান থেকে এটি একটি বড় পরিবর্তন।
চীনের ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক তথ্য প্রস্তুত করার দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয়গুলো ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে এক সারিতে কাজ করে। এছাড়া, চীনের সরকারি পরিসংখ্যান প্রায়ই বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মেলে না। এমনকি, অনেক সময় জাতীয় পরিসংখ্যান প্রকাশ করাও হয় না।
এক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্র এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি। তবে ট্রাম্প, যিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রতি তার মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন, তিনি কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংখ্যাগুলোকে আক্রমণ করছেন না, বরং অর্থনীতির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন।
মোটকথা, ট্রাম্প ভালো ফল দেখাতে চান। তিনি চান না, খারাপ ফলাফলের জন্য তাকে দায়ী করা হোক। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তার বিশাল জনসমাগমের দাবি কিংবা কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ক্রুজ জাহাজের যাত্রীদের সমুদ্রে আটকে রাখার সিদ্ধান্তের কথা সবাই জানে। এমনকি, তিনি তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ভ্যালু বাড়িয়ে দেখানোর দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, ট্রাম্পের এই ‘ভালো দেখানোর’ প্রবণতা আরও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন নতুন এক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের দিকে যাচ্ছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন