যুক্তরাষ্ট্রে নতুন বাড়ি কেনা এখন কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। রচেস্টার শহরের স্টেফানি ক্যাম্পাগনার কথাই ধরুন। পাঁচ মাস ধরে চেষ্টা করেও তিনি বাড়ি কিনতে পারছিলেন না। অবশেষে, একটি বাড়ির জন্য প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর, মূল দামের চেয়ে এক লক্ষ ডলার বেশি দিয়ে, ৩৬ জন প্রতিযোগীকে হারিয়ে তিনি সেই বাড়িটি কিনেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান আবাসন বাজারের কঠিন পরিস্থিতি এটি বুঝিয়ে দেয়। আবাসন সংকট নিয়ে সম্প্রতি সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির বৃহৎ আবাসন নির্মাণ সংস্থাগুলোর সমালোচনা করেছেন। তিনি তাদের বিরুদ্ধে জমির মালিকানা ধরে রেখে বাড়ির দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর অভিযোগ এনেছেন।
ট্রাম্পের মতে, নির্মাণ সংস্থাগুলো যেন সিন্ডিকেট বা জোটের মতো কাজ করছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সংকট আসলে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা।
এর মূল কারণ হল চাহিদার তুলনায় বাড়ির সরবরাহ কম। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার আগে আবাসন নির্মাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল এবং এরপর তা আর পুরোপুরি পুনরুদ্ধার হয়নি। নির্মাণ সংস্থা ও অর্থনীতিবিদদের মতে, জমির অভাবের কারণে নয়, বরং বিভিন্ন বিধি-নিষেধ, শ্রমিক সংকট এবং উচ্চ নির্মাণ ব্যয়ের কারণে নতুন বাড়ি তৈরি কঠিন হয়ে পড়েছে।
আবাসন ও নগর উন্নয়ন বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী শॉन ডোনোভান সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি ৩০ বছর ধরে আবাসন খাতে কাজ করছি, কিন্তু এমন সংকট আগে দেখিনি।” তিনি মনে করেন, স্থানীয় পর্যায়ে জোনিং এবং অন্যান্য আইনি জটিলতাই এই সমস্যার মূল কারণ।
ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হোম বিল্ডার্স (NAHB) এর একটি সমীক্ষা বলছে, একটি নতুন বাড়ির নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ আসে রাজ্য, স্থানীয় ও ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিধি-নিষেধের কারণে। এই সংস্থাটি আবাসন নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘নিয়ন্ত্রক বোঝা’ কমানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে তদবির করে আসছে।
গোল্ডম্যান স্যাকস-এর একটি বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যদি ভূমি ব্যবহারের নিয়ম শিথিল করা হয়, তাহলে আগামী এক দশকে অতিরিক্ত ২৫ লক্ষ আবাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যা বর্তমান আবাসনের অভাবের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পূরণ করতে সক্ষম। তবে এই সংস্কার বাস্তবায়নে অনেক বাধা রয়েছে, কারণ বেশিরভাগ নিয়মকানুন স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি হয়।
লস অ্যাঞ্জেলেসের গো হোম বিল্ডার্স-এর প্রতিষ্ঠাতা ওরেন আমির জানান, সরকারি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনার কারণে তাঁর কিছু পুনর্গঠন প্রকল্পের কাজ সময়মতো সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। শুধু উপকূলীয় শহরগুলোতেই নয়, রক্ষণশীলদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও আবাসনের সংকট দেখা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে অনেক নেতাই মনে করছেন, সরবরাহ বাড়াতে হলে নিয়মকানুন সহজ করতে হবে। ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেট গভর্নর গ্যাভিন নিউসম সম্প্রতি একটি বিল স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে কিছু এলাকার ট্রানজিট স্টেশনের কাছে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, রিপাবলিকান গভর্নর গ্রেগ জিয়ানফোর্টে আবাসন সরবরাহ বাড়াতে এবং জটিলতা কমাতে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছেন। তবে শুধু সরকারই নয়, অনেক সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরোধিতার কারণেও নির্মাণ কাজ আটকে যায়।
সাধারণত, অতিরিক্ত জনসংখ্যার আশঙ্কা বা এলাকার চরিত্র পরিবর্তনের উদ্বেগের কারণে এমনটা ঘটে। ডোনোভান বলেন, “আমাদের বুঝতে হবে, আমরা আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণের কথা বলছি না।” ট্রাম্পের নীতিও কি দায়ী?
রচেস্টারে বর্তমানে বাড়ির বাজার বেশ গরম। জিলোর মার্কেট হিট ইনডেক্স অনুযায়ী, শহরটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আকর্ষণীয় আবাসন বাজার। কোভিড পরবর্তী সময়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবং পর্যাপ্ত নির্মাণ না হওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে।
অন্যদিকে, টেক্সাস ও ফ্লোরিডার মতো কিছু রাজ্যে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম আবাসন নির্মাণ সংস্থাগুলোর কার্যক্রম বেশি, সেখানে নির্মাণ কাজ স্বাভাবিক থাকায় বাড়ির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। এমনকি কিছু শহরে দাম কমেছেও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেক্সাসের এক নির্মাণ সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জানান, তাঁর রাজ্যে কোনো জোনিং আইন না থাকায় সেখানে এমন কোনো সমস্যা নেই। তিনি সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন, তবে আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি নির্মাণ শ্রমিকদের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে, যা নির্মাণ কাজকে আরও ধীর করে দেবে।
ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হোম বিল্ডার্স (NAHB) এর সিইও জিম টোবিন বলেন, অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কার করতে সরকারের সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য ভিসা প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করা দরকার, যা কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে প্রচলিত আছে।
এদিকে, নির্মাণ সামগ্রীর ওপর নতুন শুল্ক আরোপের কারণেও বাড়ি নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে। ইউবিএস-এর গবেষণা অনুযায়ী, কাঠের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে একটি বাড়ির নির্মাণ খরচ ৭২০ ডলার পর্যন্ত বাড়বে। এছাড়া, কিচেন ক্যাবিনেট ও ভ্যানিটির ওপর শুল্কের কারণে খরচ প্রায় ২৮০ ডলার বাড়বে।
সব মিলিয়ে শুল্কের কারণে একটি বাড়ি তৈরি করতে প্রায় ৮,৯০০ ডলার বেশি খরচ হচ্ছে। আবাসন সংকট সমাধানে সময় লাগবে। গত মাসে, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট জানান, ট্রাম্প সম্ভবত এই সংকট মোকাবিলায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার কথা বিবেচনা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় আবাসন নির্মাণ সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে লেনার, ডি.আর. হর্টন এবং পালটে। ট্রাম্প সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে খালি প্লট ধরে রাখার অভিযোগ করেছেন এবং দ্রুত নির্মাণ কাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ সংস্থাগুলোর হাতে প্রচুর খালি জমি থাকলেও সেখানে নির্মাণ শুরু করাটা সহজ নয়। জমি তৈরি করতে রাস্তা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও অন্যান্য ইউটিলিটি সংযোগ করতে হয়। এছাড়া, সরকারি অনুমোদন পেতেও অনেক সময় লাগে।
সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ডোনোভান বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন সরবরাহ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়ায় তিনি উৎসাহিত। তবে তিনি যোগ করেন, “সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এর বাস্তবায়ন দেখতে হবে। একটি আবাসন সংকট রাতারাতি সমাধান করা যায় না। এই পরিস্থিতিতে আসতে যেমন অনেক বছর লেগেছে, তেমনি এটি থেকে বের হতেও সময় লাগবে।” তথ্য সূত্র: সিএনএন