চীন ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ ক্রমশ জটিল রূপ নিচ্ছে। সম্প্রতি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিরল খনিজ পদার্থের সরবরাহ পুনরায় শুরু করতে রাজি হয়েছেন। এই খনিজ পদার্থগুলো অত্যাবশ্যকীয়, বিশেষ করে প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য।
তবে, বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন সম্ভবত তাদের ‘বিরল মৃত্তিকা কার্ড’ সহজে ছাড়তে রাজি নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে সম্প্রতি একটি দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনার মূল বিষয় ছিল বাণিজ্য এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা।
ট্রাম্প জানান, তারা জেনেভায় হওয়া চুক্তির কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। জানা গেছে আগামী সোমবার লন্ডনে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনার নতুন একটি দফা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের একটি প্রধান কারণ হলো চীনের বিরল মৃত্তিকা খনিজ এবং চুম্বকের রফতানি সীমাবদ্ধতা। এই খনিজগুলো গাড়ি থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান পর্যন্ত—অনেক কিছুই তৈরিতে অপরিহার্য।
আমেরিকান শিল্প ও প্রতিরক্ষা খাতের জন্যেও এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। গত কয়েক সপ্তাহে, উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে যে বেইজিং বিরল মৃত্তিকা রফতানির অনুমোদন ধীরে ধীরে দিচ্ছে এবং জেনেভার চুক্তি রক্ষা করছে না।
ট্রাম্প দ্রুত এই বিষয়ে তার চীনা প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন।
বৃহস্পতিবারের ৯০ মিনিটের আলোচনার পর ট্রাম্প জানান, তিনি ও শি বিরল মৃত্তিকা চুম্বক সংক্রান্ত কিছু বিষয় ‘ঠিক করেছেন’। তবে তিনি বিস্তারিতভাবে জানাননি ঠিক কী কী বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
শুক্রবার এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প জানান, শি বিরল মৃত্তিকা খনিজ এবং চুম্বকের সরবরাহ পুনরায় শুরু করতে রাজি হয়েছেন। তবে কত দ্রুত এই সরবরাহ শুরু হবে বা কী পরিমাণ উপকরণ সরবরাহ করা হবে, সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
অন্যদিকে, চীনের পক্ষ থেকে আলোচনার বিষয়ে দেওয়া বিবৃতিতে বিরল মৃত্তিকা নিয়ে কোনো কথা উল্লেখ করা হয়নি। বিবৃতিতে শি জিনপিং বলেছেন, চীন বাণিজ্য চুক্তির শর্তাবলী ‘গভীরভাবে এবং আন্তরিকভাবে’ মেনে চলছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং জানান, এটি অন্যান্য সংস্থার দেখার বিষয়।
চীন, যা বিশ্বের বিরল মৃত্তিকা প্রক্রিয়াকরণের ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, শুল্ক যুদ্ধের শুরুতে গত ৪ এপ্রিল কিছু খনিজ এবং চুম্বকের রফতানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। নতুন এই ব্যবস্থার ফলে সরাসরি রফতানি বন্ধ করা হয়নি, তবে প্রতিটি চালানের জন্য সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।
চীনের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেইজিং বিরল মৃত্তিকা সরবরাহ শৃঙ্খলে তাদের প্রভাবশালী অবস্থান ছাড়তে রাজি নয়। তারা সম্ভবত ওয়াশিংটনকে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর এবং প্রযুক্তি খাতে চীনের প্রবেশাধিকার রোধ করার লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব রফতানি নিয়ন্ত্রণ সহজ করতে চাপ দিতে পারে।
সাংহাইয়ের ফুদান ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর আমেরিকান স্টাডিজের পরিচালক উ সিনবো বলেন, সম্ভবত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য আরও বেশি চালান অনুমোদিত হবে, তবে রফতানি লাইসেন্সিং ব্যবস্থা বহাল থাকবে।
তিনি উল্লেখ করেন, চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, রফতানি লাইসেন্সের অনুমোদনে সর্বোচ্চ ৪৫ কার্যদিবস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
চীনের রেনমিন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক জিন ক্যানরং বলেন, বিরল মৃত্তিকার ওপর ট্রাম্পের গুরুত্ব দেওয়া থেকে বোঝা যায়, চীনের ‘বিরল মৃত্তিকা কার্ড’ কতটা শক্তিশালী। তিনি আরও যোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনকে চিপস এবং জেট ইঞ্জিন থেকে দূরে রাখতে চায়, তবে চীনের এই কার্ড ব্যবহার করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুশনিক, ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট এবং বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার পরবর্তী বাণিজ্য আলোচনায় অংশ নেবেন বলে ট্রাম্প ঘোষণা করার পর, কিছু চীনা বিশেষজ্ঞ আশা করছেন যে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত বিধিনিষেধ নিয়ে এখন আলোচনা হতে পারে।
বেইজিং জোর দিয়ে বলেছে যে তাদের রফতানি নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, বৈষম্যমূলক নয় এবং কোনো নির্দিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে লক্ষ্যযুক্তও নয়।
বিরল মৃত্তিকা উপকরণের ‘দ্বৈত ব্যবহারের বৈশিষ্ট্য’ উল্লেখ করে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, চীন সরকার আইন ও বিধি অনুযায়ী দ্বৈত ব্যবহারের উপকরণগুলির রফতানি লাইসেন্সের আবেদন পর্যালোচনা করে।
যেসব আবেদন প্রয়োজনীয়তা পূরণ করবে, চীন তাদের অনুমোদন দেবে। এই কঠোর লাইসেন্সিং ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী এই উপকরণগুলির সরবরাহকে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত করেছে এবং আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন শিল্পে উৎপাদন অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যা কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়েছে।
আমেরিকান চেম্বার অফ কমার্স ইন চায়নার করা এক জরিপে দেখা গেছে, বিরল মৃত্তিকা রফতানি নিয়ন্ত্রণে ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৭৫ শতাংশের মতে, আগামী তিন মাসের মধ্যে তাদের মজুত ফুরিয়ে যাবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য কমিশনার মারোস সেফকোভিচ চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতোর সঙ্গে প্যারিসে এক বৈঠকে মিলিত হন এবং চীনের বিরল মৃত্তিকা নিয়ন্ত্রণের কারণে ইউরোপীয় গাড়িশিল্পের উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইউরোপ সফরের সময় ওয়াং ইইউ-এর উদ্বেগের সমাধান এবং উপযুক্ত আবেদনগুলোর অনুমোদন দ্রুত করার জন্য একটি ‘সবুজ করিডোর’ তৈরি করতে রাজি হয়েছেন।
তথ্য সূত্র: CNN