মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি: আলোচনার অগ্রগতি এবং বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেভিন হাসেট সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, তিনি সোমবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বেশ আশাবাদী। হাসেটের এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এসেছে যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে “খুব ভালো” আলোচনার কথা উল্লেখ করেছেন এবং চীন নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে বলেও জানিয়েছেন।
এই আলোচনার মূল বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু খনিজ পদার্থের সরবরাহ পুনরুদ্ধার করা। এই খনিজ পদার্থগুলো ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এবং এপ্রিল মাসের শুরুতে বাণিজ্য যুদ্ধ তীব্র হওয়ার আগে যে হারে এইগুলির সরবরাহ ছিল, সেই পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা এখন লক্ষ্য।
আলোচনার জন্য লন্ডনে বৈঠকে বসতে চলেছেন মার্কিন বাণিজ্য সচিব হাওয়ার ল্যাটনিক, ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট এবং মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জ্যামিসন গ্রিয়ার। মে মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত হওয়া বাণিজ্য আলোচনারও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গ্রিয়ার।
তবে, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাও রয়েছে। ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে অভিযোগ করেছেন যে চীন তাদের ৯০ দিনের বাণিজ্য চুক্তি “পুরোপুরি লঙ্ঘন” করেছে। এই চুক্তির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক ১৫৪% থেকে কমিয়ে ৩০%-এ এনেছিল, অন্যদিকে চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক ১২৫% থেকে কমিয়ে ১০%-এ নামিয়ে আনে।
চুক্তি অনুযায়ী, চীন ২ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরোপিত শুল্ক বহির্ভূত ব্যবস্থা স্থগিত বা বাতিল করতে রাজি হয়েছিল। চীনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার মধ্যে কিছু বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থের রফতানি সীমিত করাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা আইফোন, বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং যুদ্ধ বিমানের মতো পণ্যের জন্য অপরিহার্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বছর ২ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন বাণিজ্য অংশীদারদের উপর ব্যাপক “পাল্টা” শুল্ক আরোপ করে, যা পরে ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয় এবং ১০%-এ নামিয়ে আনা হয়। আসন্ন ৯ জুলাই সময়সীমার মধ্যে বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে চীন, শুল্কের বোঝা বহন করবে। তবে, ব্যবসায়ী এবং অর্থনীতিবিদরা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁদের মতে, এর ফলে ভোক্তা ব্যয় নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং সম্ভাব্য মন্দার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
এমন উদ্বেগের মধ্যে, এপ্রিলে মার্কিন মুদ্রাস্ফীতি চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ভোক্তা মূল্য সূচক (Consumer Price Index) অনুযায়ী, বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি মার্চে ২.৪% থেকে কমে এপ্রিলে ২.৩% হয়েছে, যেখানে ভোক্তা মূল্য ০.২% বেড়েছে।
হিসেটের মতে, সরকারের নীতিগুলি মুদ্রাস্ফীতি কমাতে এবং অন্যান্য দেশ থেকে রাজস্ব পাওয়ার মাধ্যমে ঘাটতি কমাতে সহায়তা করছে। ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, এপ্রিলে কাস্টমস শুল্ক বাবদ রেকর্ড ১৬.৩ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা মার্চে আদায় হওয়া ৮.৭৫ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে অনেক বেশি।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাস থেকে শুরু হওয়া ২০২৫ অর্থবছরের শুরু থেকে, যুক্তরাষ্ট্র কাস্টমস শুল্ক বাবদ প্রায় ৬৩.৩ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার বেশি। কংগ্রেসনাল বাজেট অফিসের (Congressional Budget Office – CBO) অনুমান অনুযায়ী, শুল্ক রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে, মার্কিন অর্থনীতির উপর প্রভাব বিবেচনা না করেই, আগামী এক দশকে মোট ঘাটতি ৩ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত কমানো যেতে পারে।
২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঘাটতি ছিল প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৭%। হাউস রিপাবলিকানদের একটি প্রস্তাব অনুযায়ী, ট্রাম্পের নীতি বাস্তবায়নে সরকারের ঋণ আরও ৩.৮ ট্রিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেকার এই বাণিজ্য আলোচনার ফলাফল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, যা একটি প্রধান রপ্তানিকারক দেশ, তার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব বাণিজ্য নীতির পরিবর্তনের ফলে এর ওপর প্রভাব পড়তে পারে। বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনগুলি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে।
(বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী, ১ মার্কিন ডলার = ১১০.৮৫ বাংলাদেশি টাকা। সেই হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঘাটতি প্রায় ২২০.১৬ ট্রিলিয়ন টাকা।)
তথ্য সূত্র: সিএনএন