ট্রাম্পের চীন চুক্তি: ধোঁকা নাকি বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত?

চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ‘যুদ্ধবিরতি’, কতটা সফল ট্রাম্পের কৌশল?

যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা বাণিজ্য যুদ্ধের একটি নতুন মোড় দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি দুই দেশ একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। যদিও এই চুক্তিকে কতখানি কার্যকর বা ফলপ্রসূ বলা যায়, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, এর আগেও দু’দেশের মধ্যে এমন চুক্তি হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বেশি দিন টেকেনি।

বিশ্ব অর্থনীতিতে এই দুই বৃহৎ শক্তির বাণিজ্য সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো, দুই দেশের মধ্যে শুল্ক এবং রফতানি সংক্রান্ত কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করা। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হওয়ার পাশাপাশি, বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে এটি সহায়ক হতে পারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি একসময় এই বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তিনি এই চুক্তিকে তাঁর সাফল্যের একটি অংশ হিসেবে তুলে ধরছেন। তিনি এটিকে ‘চুক্তি সম্পন্ন’ বলেও উল্লেখ করেছেন।

তবে, বাস্তব চিত্র সম্ভবত ভিন্ন। যদিও উভয় পক্ষই রফতানি শুল্ক কমানোর বিষয়ে রাজি হয়েছে, তারপরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বাধা এখনো বিদ্যমান। যেমন, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা অনেক পণ্যের ওপর এখনো উচ্চ হারে শুল্ক বহাল রয়েছে। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি পণ্য, বিশেষ করে অত্যাধুনিক সেমিকন্ডাক্টর চিপস, চীনে রফতানির ক্ষেত্রে এখনো জটিলতা রয়েছে।

আসল সমস্যা হলো, দুই দেশের মধ্যেকার গভীর অবিশ্বাস। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, চীন তাদের মেধাস্বত্ব চুরি করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে চীনে ব্যবসা করতে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। চীন অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে। এই অবিশ্বাস দূর না হলে, বাণিজ্য চুক্তিগুলো বেশি দিন টিকবে না বলেই মনে হয়।

বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তির ফলে উভয় দেশের অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে, বিরল মৃত্তিকা ধাতু (rare earth minerals) রফতানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়ায়, ইলেক্ট্রনিক্স, গাড়ির ইঞ্জিন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে কাঁচামালের সরবরাহ সহজ হবে। তবে, এটি এখনো নিশ্চিত নয় যে, চীন এই চুক্তির শর্ত কতটা মানবে। অতীতেও দেখা গেছে, চীন বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সেই ধারা বজায় রেখেছেন। এমনকি, কিছু ক্ষেত্রে তিনি শুল্কের পরিমাণ আরও বাড়িয়েছেন। এর কারণ হলো, চীন থেকে আসা ফেন্টানাইল (fentanyl) নামক মাদক পাচার বন্ধ করা। এই শুল্কের কারণে অনেক মার্কিন কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে।

এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে, অনেক বহুজাতিক কোম্পানি তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। যেমন, অ্যাপল তাদের কিছু আইফোন চীন থেকে ভারতে পাঠাতে শুরু করেছে। তবে, শুল্কের কারণে তাদের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বোয়িং-এর মতো কোম্পানিগুলো চীনের বাজারে প্রায় ব্যবসা করতে পারছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে পণ্যের দাম বাড়ে, বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যায়। তবে, যদি এই চুক্তি কার্যকর হয়, তাহলে বাণিজ্য বাধা কমবে এবং উভয় দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে।

বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব:

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেকার এই বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। কারণ, বিশ্ব অর্থনীতির দুই প্রধান চালিকাশক্তির মধ্যেকার এই বিরোধ, বিশ্ব বাণিজ্য এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব ফেলে। এর ফলে, বাংলাদেশের আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যেও কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।

যেমন, যদি চীন থেকে আসা পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি পায়, তাহলে বাংলাদেশের বাজারেও তার প্রভাব পড়তে পারে। আবার, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য বাড়লে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে। তাই, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *