যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (ইপিএ)-র এক প্রস্তাব অনুযায়ী, কয়লা ও গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে নির্গত হওয়া বায়ু দূষণ এবং কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের বিদ্যমান নিয়মাবলী বাতিল করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে নেওয়া এই পদক্ষেপের ফলে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইপিএ-র প্রধান লি জ়েলডিন বুধবার জানান, সংস্থাটি কার্বন নিঃসরণ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট পারদসহ অন্যান্য বিষাক্ত বায়ু দূষণ বিষয়ক একটি আলাদা নিয়ম বাতিল করতে চাইছে। সংস্থাটির যুক্তি হলো, জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ‘ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট’-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘বিপজ্জনক’ বায়ু দূষণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে না।
এই প্রস্তাবগুলো ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি নীতিমালার অবসান ঘটাচ্ছে। যদি প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করা হয়, তবে এর ফলস্বরূপ জনস্বাস্থ্য এবং জ্বালানি মূল্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
জ়েলডিন আরও বলেন, “আমরা সবসময় পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর কয়লার পক্ষে। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ উত্তোলন এবং মিত্র দেশগুলোতে রপ্তানির জন্য কয়লা ব্যবহার করব।
ইপিএ-র পক্ষ থেকে কার্বন নিঃসরণ সংক্রান্ত নিয়মগুলো প্রতিস্থাপনের জন্য নতুন কোনো প্রস্তাব এখনো জানানো হয়নি। ফলে প্রস্তাবিত বাতিলকরণ চূড়ান্ত হলে, যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে কার্বন নিঃসরণ অনিয়ন্ত্রিত থেকে যেতে পারে। জ়েলডিন আরও জানান, তাঁর সংস্থা পারদ ও অন্যান্য বিষাক্ত বায়ু দূষণ বিষয়ক নিয়মাবলী সংশোধন করবে, যা বাইডেন প্রশাসনের গত বছরের চূড়ান্ত করা একটি নিয়ম বাতিল করার প্রস্তাব।
যুক্তরাষ্ট্রে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দূষণের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। দেশটির জলবায়ু দূষণে প্রায় এক চতুর্থাংশ অবদান রাখে এই কেন্দ্রগুলো। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোই বৈশ্বিক জলবায়ু দূষণে ৩ শতাংশের বেশি অবদান রাখে।
হার্ভার্ড ল’ স্কুলের পরিবেশ ও জ্বালানি আইন প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক ক্যারি জেন্কস-এর মতে, কার্বন বিষয়ক নিয়মগুলো বাতিল করার এই প্রস্তাব ট্রাম্পের আগের মেয়াদের নীতি থেকেও অনেক বেশি বিস্তৃত।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এর ফলে পুরনো কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকবে এবং নতুন গ্যাস প্ল্যান্টগুলো দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কম বিধিনিষেধের সঙ্গে তৈরি হতে পারবে।
অন্যদিকে, মিশিগানের একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা গত মাসে বন্ধ হওয়ার কথা ছিল, সম্প্রতি দেশটির জ্বালানি বিভাগ সেটিকে পুরো গ্রীষ্মকাল চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছে। যদিও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ইউটিলিটি, রাজ্য নিয়ন্ত্রক এবং আঞ্চলিক গ্রিড অপারেটর এমন কোনো অনুরোধ জানায়নি। মিশিগান রাজ্যের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্তের কারণে মধ্য-পশ্চিমের গ্রাহকদের কয়েক কোটি ডলার বেশি খরচ করতে হবে।
কয়লা সবচেয়ে বেশি দূষণ সৃষ্টিকারী জীবাশ্ম জ্বালানি। প্রস্তাবিত নিয়ম বাতিল হলে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু থাকার কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যেতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থাগুলোও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, প্রস্তাবিত এই পদক্ষেপ বায়ুর গুণগত মান আরও খারাপ করবে।
আমেরিকান লাং অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হ্যারল্ড উইমার এক বিবৃতিতে বলেন, “জনস্বাস্থ্যকে দুর্বল করা এবং ইপিএ-র মিশনকে খাটো করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সংস্থাটির মূল লক্ষ্য হলো জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষা করা, মানুষকে আরও বেশি বিষাক্ত দূষণের শিকার হতে দেওয়া নয়।”
বাইডেন প্রশাসনের নীতি ছিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে দূষণ কমিয়ে আনা এবং সেখানকার বাতাসকে মানুষের শ্বাস নেওয়ার উপযোগী করে তোলা। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেই নীতি থেকে সরে এসে জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে চাইছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনে আরও বেশি অবদান রাখবে।
এই সিদ্ধান্তের সমর্থন করে জ়েলডিন বলেন, “প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এবং আমরা সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করছি।”
কয়লা উৎপাদনকারী রাজ্যগুলোর রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা এবং নাভাজো জাতির প্রেসিডেন্ট বু নুগ্রেনও জ়েলডিনের সঙ্গে ছিলেন। নুগ্রেন তাঁর এলাকার মানুষের জন্য কয়লা খনি ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অফ লেবার স্ট্যাটিস্টিক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে কয়লা খনি শ্রমিক ছিল প্রায় ৭০ হাজার। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজারে।
প্রস্তাবিত এই পরিবর্তনের ওপর জনমত যাচাইয়ের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পাশাপাশি, ইপিএ-র পক্ষ থেকে এ বছর শেষের দিকে জলবায়ু দূষণের বিপদ সম্পর্কে ২০০৯ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করারও কথা রয়েছে। পরিবেশ বিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, এটি হলে জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্টিকারী দূষণ নিয়ন্ত্রণে ইপিএ-র ক্ষমতা কমে যাবে।
ক্লিন এয়ার টাস্ক ফোর্সের আইনজীবী ফ্র্যাঙ্ক স্টারগেস বলেন, “প্রস্তাবিত এই বাতিলকরণ ‘ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট’-এর অধীনে দূষণ হ্রাসের বাধ্যবাধকতাকে লঙ্ঘন করে। ইপিএ-কে অবশ্যই এই প্রস্তাব বাতিল করতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন