যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ: শিশুদের ফিরিয়ে আনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কি হারাতে বসেছে?

যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ হারানোর শঙ্কা: ইউক্রেন থেকে অপহৃত শিশুদের তথ্য নিয়ে উদ্বেগে গবেষকরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রশাসনের অর্থায়ন বন্ধের কারণে ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের একটি ভান্ডার থেকে গবেষকদের প্রবেশাধিকার হারানোর খবর পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়ান বাহিনীর হাতে অপহৃত ৩০,০০০ এর বেশি ইউক্রেনীয় শিশুর অবস্থান সম্পর্কিত সংবেদনশীল তথ্য। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের একটি চিঠি এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রের মাধ্যমে এই তথ্য জানা গেছে।

২০২২ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর ‘ইউক্রেন কনফ্লিক্ট অবজারভেটরি’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য নৃশংসতার প্রমাণ সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও তা সকলের জন্য উন্মুক্ত করা।

কিন্তু, ট্রাম্প প্রশাসনের সময় বিদেশি সহায়তা বন্ধের অংশ হিসেবে এই প্রকল্পের অর্থায়নও স্থগিত করা হয়। এ বিষয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস (Tammy Bruce) বুধবার জানান, “যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা যে মূল্যায়ন করেছি, তার ভিত্তিতেই এই অর্থায়ন বন্ধ করা হয়েছে।”

জানা গেছে, ‘ইউক্রেন কনফ্লিক্ট অবজারভেটরি’ কর্তৃক সংগৃহীত প্রমাণগুলি রাশিয়া কর্মকর্তাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (International Criminal Court) কর্তৃক রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের (Vladimir Putin) বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ক্ষেত্রেও এই তথ্য-উপাত্ত সহায়তা করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, অর্থায়ন স্থগিত করার পর তথ্যভাণ্ডারটি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের (Yale University) গবেষকরা এর প্রবেশাধিকার হারান। এছাড়াও, স্যাটেলাইট চিত্র (satellite imaging) সহ যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ থেকেও গবেষকদেরaccess বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সূত্রটি আরও জানায়, তথ্যভাণ্ডারে শুধুমাত্র অপহৃত শিশুদের তথ্যই ছিল না, বরং রাশিয়ার অন্যান্য যুদ্ধাপরাধ, যেমন— জ্বালানি অবকাঠামো, বেসামরিক স্থাপনা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর হামলার প্রমাণও সেখানে সংরক্ষিত ছিল।

এই ডেটাবেসটি বিশেষভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো একত্রিত করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে ডেটাবেসটির নিয়ন্ত্রণ কার কাছে, এর মধ্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের কী হবে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ‘ইউরোপোল’-এর (Europol) সঙ্গে এটি শেয়ার করা হবে কিনা—তা এখনো স্পষ্ট নয়।

মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইয়েলের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব (HRL) (Yale Humanitarian Research Lab) ‘ইউক্রেন কনফ্লিক্ট অবজারভেটরি’-র হয়ে গবেষণা পরিচালনা করে আসছিল। তারা স্যাটেলাইট চিত্র ও বায়োমেট্রিক ডেটা (biometric data) ব্যবহার করে ৩০,০০০ এর বেশি অপহৃত ইউক্রেনীয় শিশুর পরিচয় ও তাদের সম্ভাব্য অবস্থান চিহ্নিত করে তিনটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, “শিশুদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ইউক্রেনের প্রচেষ্টায় এই ডেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” এই মাসের শুরুতে সৌদি আরবের জেদ্দায় (Jeddah) অনুষ্ঠিত শীর্ষ মার্কিন ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের বৈঠকে ‘জোরপূর্বক স্থানান্তরিত ইউক্রেনীয় শিশুদের’ ফিরিয়ে আনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়।

এছাড়াও, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির (Volodymyr Zelensky) সঙ্গে এক ফোনালাপে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) “যুদ্ধ চলাকালীন ইউক্রেন থেকে নিখোঁজ হওয়া শিশুদের, বিশেষ করে অপহরণের শিকার হওয়া শিশুদের বিষয়ে জানতে চান।

ট্রাম্প উভয় দেশকে শিশুদের ফিরিয়ে আনতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ওহাইও রাজ্যের ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান গ্রেগ ল্যান্ডসম্যানের (Greg Landsman) নেতৃত্বে দেওয়া বুধবারের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সংগৃহীত প্রমাণগুলি ‘ইউরোপোল’ এবং ইউক্রেন সরকারের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছিল, যাতে শিশুদের ফিরিয়ে আনা যায়।

চিঠিতে আরও বলা হয়, “ইয়েল এইচআরএল-এর (Yale HRL) অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সুরক্ষিত তথ্য ভান্ডারের (secure evidence repository) বর্তমান অবস্থা অজানা। এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদটি হারিয়ে যেতে পারে না।” কংগ্রেসনাল প্রতিনিধিরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, ডেটাবেসের তথ্য সম্ভবত স্থায়ীভাবে মুছে ফেলা হয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, “যদি এটি সত্যি হয়, তবে এর ভয়াবহ পরিণতি হবে।” এই চিঠিতে নেব্রাস্কার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ডন বেকনসহ (Don Bacon) মোট ১৭ জন আইনপ্রণেতা স্বাক্ষর করেছেন।

তবে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এবং অপর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ডেটা মুছে ফেলা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মুখপাত্র জানান, “কনফ্লিক্ট অবজারভেটরির ডেটা স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে নেই। তথ্যগুলো এমআইটিআরই (MITRE) নামক একটি সংস্থার প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষিত আছে।”

এমআইটিআরই (MITRE) জানিয়েছে, তাদের ধারণা ও বিশ্বাস অনুযায়ী, গবেষণা ডেটা মুছে ফেলা হয়নি এবং এটি বর্তমানে এই চুক্তির একজন প্রাক্তন অংশীদার দ্বারা রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়াও, স্টেট ডিপার্টমেন্টকে ডেটা হস্তান্তরের বিষয়টি জানানো হয়েছে। তথ্য সূত্র: সিএনএন (CNN)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *