ইরানে পারমাণবিক বোমা: ট্রাম্পের হুমকিতে নতুন আলোচনা!

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক হুমকি দেশটির অভ্যন্তরে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ইরানের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনেকেই এখন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার বিষয়ে তেহরানের পুরনো অবস্থান পরিবর্তনের কথা ভাবছেন।

খবর আল জাজিরার।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। এমনকি তিনি স্বল্পমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রমও বন্ধের কথা বলেছেন।

ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। যদিও ইরান সবসময় বলে এসেছে, হুতিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বাধীন।

ট্রাম্পের এমন কঠোর অবস্থানের কারণে ইরানের অভ্যন্তরে অনেকে পারমাণবিক বোমা তৈরির পক্ষে মত দিচ্ছেন। দেশটির প্রভাবশালী একটি দৈনিক পত্রিকা, ‘ভ্যাতান-এ এমরুজ’ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায়, ট্রাম্পের নীতির কারণে নিরাপত্তা বিবেচনায় অনেক দেশই পারমাণবিক বোমা তৈরির কথা বিবেচনা করতে পারে।

পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে একটি পারমাণবিক বিস্ফোরণের ছবি ব্যবহার করে শিরোনাম করেছে, ‘নিউক্লিয়ার বছর’। ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘নূর নিউজ’ জানিয়েছে, ট্রাম্প এবং তার দল যদি হুমকি অব্যাহত রাখে, তাহলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে পারে।

ইরানের পার্লামেন্টের একজন সদস্য, আহমাদ নাদেরি, গত সপ্তাহে পার্লামেন্টের অধিবেশনে বলেন, ‘সম্ভবত আমাদের পারমাণবিক, সামরিক এবং নিরাপত্তা নীতি নতুন করে পর্যালোচনা করার সময় এসেছে।’ তিনি আরও বলেন, ইরানের পারমাণবিক বোমা থাকা উচিত, অন্যথায় এই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

ইরানের প্রভাবশালী কট্টরপন্থী মহলে এই ধরনের বক্তব্য ক্রমশ বাড়ছে। তাদের মতে, দেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা অপরিহার্য।

তবে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি, যিনি বর্তমানে গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, সম্প্রতি এক মন্তব্যে বলেন, ‘আমরা যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইতাম, তাহলে আমেরিকা আমাদের আটকাতে পারত না। আমরা যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করি, তবে এর কারণ হলো আমরা তা চাই না।’

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের কাছে ইতিমধ্যে কয়েকটি বোমা বানানোর মতো পারমাণবিক উপাদান মজুত আছে, তবে তারা এখনো সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

২০১৮ সালে ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে হওয়া আন্তর্জাতিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে একতরফাভাবে সরিয়ে নেওয়ার পর, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে ওয়াশিংটনের ইউরোপীয় মিত্ররা কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারা ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল না করেই তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।

এমনকি তারা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ-এর বোর্ড মিটিংয়ে ইরানের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব এনেছে এবং ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় জানতে চেয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা এবং আইএইএ-এর সঙ্গে সহযোগিতা নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনার কারণে তেহরান চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে। বিশেষ করে, তারা ইরানের পারমাণবিক ইস্যু এবং নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে একটি অভিন্ন অবস্থান নিতে বেইজিংয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য ইরানের ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করার জন্য ‘স্ন্যাপব্যাক’ ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। তবে চীন ও রাশিয়া এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে।

ইরান অবশ্য রাশিয়ার কাছে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, যুদ্ধের কয়েক মাস আগে তারা রাশিয়াকে কিছু ড্রোন সরবরাহ করেছিল।

এদিকে, চলতি সপ্তাহে ইরানের কর্মকর্তারা আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসি’র সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার পর তেহরান এটিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক টেলিফোন আলাপে একমত হয়েছেন যে, ‘ইসরায়েলকে ধ্বংস করার মতো কোনো অবস্থানে ইরানের যাওয়া উচিত নয়।’

ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি, ‘ইয়েমেনের হুতিদের ছোড়া প্রতিটি গুলিকে ইরানের আক্রমণ হিসেবে দেখা হবে’ – এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। ট্রাম্প তার ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ প্ল্যাটফর্মে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ইরান হুতিদের ‘তথাকথিত গোয়েন্দা তথ্য’ সরবরাহ করে।

ইরানের গণমাধ্যম ও অনলাইনে এই বিষয়টি ইরানের ‘জাগ্রোস’ যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সামরিক হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইরানি সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে অনলাইনে প্রচারিত এমন খবরকে ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছিল, ‘জাগ্রোস’ যুদ্ধজাহাজ ক্ষেপণাস্ত্রের শিকার হয়েছে। তারা জানায়, জাহাজটি নিরাপদে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে বন্দর আব্বাসে নোঙ্গর করা আছে।

অন্যদিকে, ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি-র সঙ্গে যুক্ত টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলো মঙ্গলবার (গতকাল) দাবি করেছে, লোহিত সাগর, বাব-আল-মান্দেব প্রণালী এবং ভারত মহাসাগরে ইরানের নৌবাহিনীর কোনো জাহাজ নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় ইরানের মুদ্রা রিয়ালের দর পতন অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার খোলা বাজারে এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে রিয়ালের দাম ১০ লাখের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, যদিও পরে তা কিছুটা স্থিতিশীল হয়।

ট্রাম্প তার ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতির অধীনে ইরানের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানালেও, তিনি সম্প্রতি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, এতে আলোচনার মাধ্যমে অথবা সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাঈল বাঘাই জানিয়েছেন, চিঠিটি ট্রাম্পের আগের বক্তব্যগুলোর মতোই।

তিনি আরও বলেন, ‘সর্বোচ্চ চাপের’ অধীনে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং বিস্তারিত পর্যালোচনার পর এর জবাব দেওয়া হবে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *