ট্রাম্পের কর্মী ছাঁটাই: বিলিয়ন ডলার রাজস্ব হারানোর শঙ্কা!

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবা (আইআরএস)-এ কর্মী ছাঁটাইয়ের ফলে দেশটির রাজস্ব খাতে শত শত বিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কর বিশেষজ্ঞ, আইআরএস কর্মী এবং সাবেক ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, এই পদক্ষেপ সরকারের অর্থ সাশ্রয়ের পরিবর্তে বরং বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হবে।

জানা গেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আইআরএস-এর প্রায় ২৪ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। বর্তমানে সংস্থাটিতে কর্মীর সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। এই কর্মী ছাঁটাইয়ের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেই সব কর্মকর্তা, যারা কর ফাঁকি উন্মোচন এবং বকেয়া কর আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকেন।

সাবেক এক আইআরএস কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএনএন-কে জানান, তিনি কর্মীদের কর ফাঁকি দেওয়া থেকে পাওয়া অর্থ আদায় করতেন। তিনি আরও বলেন, “আমি আমার বেতনের তিন থেকে চারগুণ বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছি। অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার রাজস্ব আদায় করা সম্ভব।

বর্তমানে আইআরএস-এর একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই কর্মী ছাঁটাইয়ের ফলে তাদের বিভাগেরও ক্ষতি হবে, যা অলাভজনক সংস্থাগুলোর করমুক্তির আবেদন প্রক্রিয়া করে থাকে। তিনি বলেন, “আমরা অর্থ উপার্জন করি। শুধু আবেদন ফি থেকেই আমার দল কয়েক মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে।

যদিও ২০২৪ সালের কর রাজস্ব এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি, তবে এর কারণ হতে পারে আগের বছরের শক্তিশালী অর্থনীতি এবং শেয়ার বাজার, যা করযোগ্য আয় বাড়িয়েছিল। তবে, রিপাবলিকানরা ট্রাম্পের আগের মেয়াদের কর হ্রাসের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য নতুন কর আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছেন, যা সম্ভবত আরও ট্রিলিয়ন ডলার রাজস্ব কমাতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭০০ বিলিয়ন ডলার “ট্যাক্স গ্যাপ” রয়েছে, অর্থাৎ যে পরিমাণ অর্থ পাওনা রয়েছে, কিন্তু পরিশোধ করা হয়নি। রাজস্বের আরও ক্ষতি হলে দেশটির ঋণ পরিশোধ এবং সরকারি পরিষেবা খাতে অর্থ যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। মুডি’স সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং বাজেট ঘাটতির কারণে দেশটির ঋণমান কমিয়েছে।

সাবেক ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা এবং আরবান-ব্রুকিংস ট্যাক্স পলিসি সেন্টারের সিনিয়র ফেলো জ্যানেট হল্টজব্লাট বলেন, “বর্তমানে আইআরএস-এর যা ঘটছে, তাতে রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

এদিকে, ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেছেন, ভবিষ্যতে আইআরএস-এর প্রযুক্তি আধুনিকীকরণের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ “খুব শক্তিশালী” থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, ক্ষতির আশঙ্কা নিয়ে জানতে চাইলে ট্রেজারির একজন মুখপাত্র কোনো বিকল্প মূল্যায়ন দিতে রাজি হননি।

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার মতে, আইআরএস-এর কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রভাব কর রাজস্বের ওপর পড়তে পারে। সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেস-এর একটি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুসারে, যদি ট্রাম্পের প্রস্তাবিত কর্মী ছাঁটাই ৫০ শতাংশে পৌঁছায়, তাহলে ২০৩৬ সাল নাগাদ প্রায় ৯0৯ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৯৯ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি) রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া, ইয়েল বাজেট ল্যাব অনুমান করেছে যে, কর্মী ছাঁটাই ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনলে আগামী এক দশকে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩৮ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি) রাজস্ব কমতে পারে।

সাবেক ট্রেজারি সেক্রেটারি ল্যারি সামারস বলেন, “আমি এটা নিয়ে সত্যিই উদ্বিগ্ন। আমরা বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতির দিকে যাচ্ছি।

বর্তমানে আইআরএস-এর কর্মী সংখ্যা ২৪ শতাংশ কমানো হয়েছে। এই ছাঁটাই প্রক্রিয়া আরও বাড়বে, কারণ আইআরএস হাজার হাজার অতিরিক্ত কর্মীদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিচ্ছে। কর্মকর্তাদের ছাঁটাইয়ের হার ৩১ শতাংশে পৌঁছানোয় উদ্বেগ আরও বাড়ছে। কারণ, কর ফাঁকির একটা বড় অংশ আসে শীর্ষ ১০ শতাংশ করদাতার কাছ থেকে এবং তাদের নিরীক্ষার (audit) সংখ্যা হ্রাস পেলে তাদের সুবিধা হবে।

বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিরীক্ষার মাধ্যমে ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়। একটি অলাভজনক অর্থনৈতিক জার্নালের গবেষণায় দেখা গেছে, শীর্ষ ১ শতাংশ উপার্জনকারীর নিরীক্ষার জন্য ১ ডলার খরচ করলে ৪ ডলার এবং শীর্ষ ০.১ শতাংশ উপার্জনকারীর নিরীক্ষার জন্য ১ ডলার খরচ করলে ৬ ডলার রাজস্ব পাওয়া যায়।

এদিকে, গ্রাহক পরিষেবাতেও কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। ট্রেজারি বিভাগের ওয়াচডগ রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২,৫০০ গ্রাহক পরিষেবা প্রতিনিধিকে ছাঁটাই করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ১০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের ফলে গ্রাহক পরিষেবা দুর্বল হয়ে গেলে করদাতারা হয়তো কর পরিশোধ করতে নিরুৎসাহিত হবেন, যার ফলশ্রুতিতে রাজস্ব কমতে পারে।

ফেব্রুয়ারিতে, সাতজন সাবেক আইআরএস কমিশনার এক যৌথ বিবৃতিতে সতর্ক করে বলেছেন, কর্মী ছাঁটাইয়ের ফলে রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কর ফাঁকির ধারণা বাড়লে স্বেচ্ছায় কর পরিশোধের প্রবণতা কমতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের কর ব্যবস্থা নিয়ে এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু রয়েছে। উন্নত কর ব্যবস্থাপনার অভাবে অনেক দেশ রাজস্ব ঘাটতিতে ভোগে, যা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে। তাই, উন্নত দেশগুলোর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের কর ব্যবস্থাপনাকে আরও শক্তিশালী করা জরুরি।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *