যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিচারকদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যারা তার নীতির বিরোধিতা করেছেন, তাদের প্রতি তিনি প্রায়ই আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন।
সম্প্রতি, ট্রাম্প একজন ফেডারেল বিচারককে ‘উগ্র বামপন্থী’ আখ্যা দিয়ে ভেনেজুয়েলার অভিবাসীদের বিতাড়িত করার বিষয়ে তার নিষেধাজ্ঞাকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি আদালতের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ আরও একবার প্রকাশ করেছেন।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ট্রাম্প বিচারক জেমস বোয়াসবার্গকে অভিশংসন করারও দাবি জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিচারক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছেন।
ট্রাম্পের মতে, “আমরা আমাদের দেশে সহিংস, উন্মত্ত এবং বিকৃত অপরাধী, যাদের অনেকেই উন্মাদ খুনি, তাদের চাই না।” বিচারক বোয়াসবার্গ ওয়াশিংটন ডিসির ফেডারেল জেলা আদালতে কর্মরত আছেন।
শনিবার তিনি ভেনেজুয়েলার অভিবাসীদের বিতাড়িত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর থেকেই ট্রাম্পের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
আগেও ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে বোয়াসবার্গের নির্দেশ অমান্য করার অভিযোগ উঠেছে। জানা যায় বিচারকের নির্দেশ উপেক্ষা করে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত এল সালভাদরের কারাগারে ভেনেজুয়েলার অভিবাসীদের বহনকারী বেশ কয়েকটি বিমান পাঠানো হয়েছে।
ট্রাম্প এক্ষেত্রে ১৭৯৮ সালের ‘এলাইন এনিমিজ অ্যাক্ট’-এর কথা উল্লেখ করেছেন, যা সাধারণত যুদ্ধকালীন সময়ে শত্রু দেশ থেকে আসা নাগরিকদের লক্ষ্য করে প্রয়োগ করা হয়।
ট্রাম্পের এই ধরনের কর্মকাণ্ড নতুন নয়। এর আগেও, আদালত যখনই তার কোনো নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, তখনই তিনি বিচারকদের আক্রমণ করেছেন।
এমনকি রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নীরবতার সুযোগে তিনি আদালতের স্বাধীনতাকে খর্ব করার চেষ্টা করেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি বিচারকের বিরুদ্ধে ‘সরকারে হস্তক্ষেপের’ অভিযোগ এনেছেন।
শ্বেত হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট মনে করেন, বিচারকরা ‘বিচারিক সক্রিয়তা’ দেখাচ্ছেন।
ট্রাম্প বোয়াসবার্গকে ‘বারাক হোসেন ওবামার নিয়োগ করা উগ্র বামপন্থী উন্মাদ’ বলেও অভিহিত করেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস বোয়াসবার্গকে অভিশংসনের বিরোধিতা করলেও ট্রাম্প তাকেও ছাড়েননি। ট্রাম্প এমনকি সুপ্রিম কোর্টকেও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট বলে ইঙ্গিত করেছেন।
২০১৬ সাল থেকে, ট্রাম্পের বিচারকদের প্রতি এই ধরনের আক্রমণ একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, কোনো রায় তার বিপক্ষে গেলে তিনি সংশ্লিষ্ট বিচারককে হয়unbiased, অযোগ্য অথবা বামপন্থী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
২০১৬ সালে, প্রেসিডেন্ট প্রার্থী থাকাকালীন ট্রাম্প, তার ‘ট্রাম্প ইউনিভার্সিটি’র বিরুদ্ধে হওয়া মামলার বিচারক গঞ্জালো কুরিয়েলকে মেক্সিকান বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে আক্রমণ করেন। তিনি ইঙ্গিত করেন, কুরিয়েল তার প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারবেন না।
হোয়াইট হাউজে আসার পরও ট্রাম্প বিচার বিভাগের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান। ২০১৭ সালে, বিচারক জেমস রবার্ট মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোর ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করার রায় দিলে, ট্রাম্প তাকে ‘তথাকথিত বিচারক’ আখ্যা দেন এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন।
২০১৮ সালে, নবম সার্কিটের বিচারক জোন টিগারকে তিনি ‘ওবামার বিচারক’ বলেন, কারণ তিনি রায় দিয়েছিলেন যে একজন অভিবাসী যে কোনো স্থান থেকে প্রবেশ করলেই আশ্রয় চাইতে পারেন।
২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর, ট্রাম্পের আক্রমণের ধারা আরও তীব্র হয়। তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল পাল্টানোর চেষ্টা করেন, যা সুপ্রিম কোর্ট প্রত্যাখ্যান করে।
এরপর তিনি প্রধান বিচারপতি রবার্টসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তাকে ‘লজ্জাজনক’ ও ‘হতাশাজনক’ বলে মন্তব্য করেন।
নির্বাচনে হস্তক্ষেপ এবং ব্যবসায়িক জালিয়াতির মতো একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর, ট্রাম্প তার মামলার বিচারকদের আক্রমণ করতে থাকেন।
নিউ ইয়র্কের দেওয়ানি জালিয়াতির মামলায়, যেখানে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, সেখানে বিচারক আর্থার এনগোরনকে তিনি ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’ এবং ‘ট্রাম্প-বিদ্বেষী, উগ্র বামপন্থী, ডেমোক্র্যাট অপারেটিভ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এমনকি তিনি তার ক্লার্ককেও ব্যঙ্গ করেন, যার ফলশ্রুতিতে আদালত তাকে মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়।
ফেডারেল নির্বাচন সংক্রান্ত মামলায় বিচারক তানিয়া চুটকানকে ট্রাম্প ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ এবং ‘অন্যায্য’ বলে অভিহিত করেন। এই ধরনের মন্তব্য বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি হুমকিস্বরূপ এবং বিচারক ও আদালতের কর্মীদের প্রতি সহিংসতার উস্কানি দিতে পারে বলে আইনজীবীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ট্রাম্প উদারপন্থী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরও আক্রমণ করেছেন, বিশেষ করে সোনিয়া সোটোমায়োর এবং রুথ বেডার জিন্সবার্গকে। ২০২০ সালে, তিনি এই দুই বিচারককে তার মামলা থেকে ‘স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানোর’ দাবি জানান।
ট্রাম্পের এই ধরনের বাগ্বিতণ্ডা শুধু তার সমর্থকদের মধ্যে বিচার বিভাগের প্রতি সন্দেহ তৈরি করেনি, বরং কিছু মানুষকে বিচারক ও তাদের পরিবারের প্রতি হয়রানি করতেও উৎসাহিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, নিউ ইয়র্কের ফৌজদারি মামলার বিচারক জুয়ান মার্চানকে ট্রাম্পের সমালোচনার পর হত্যার হুমকি দেওয়া হয় এবং তার আদালতে বিদ্বেষপূর্ণ বার্তা পাঠানো হয়।
সাবেক ফেডারেল বিচারক জে মাইকেল লুটিগ গত বছর ট্রাম্পের বাগ্ভঙ্গিকে ‘নিষ্ঠুর’ এবং ‘আইনের শাসনের প্রতি অস্তিত্বের হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এই ধরনের আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক সংকট ডেকে আনতে পারে। ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স এবং হাউস স্পিকার মাইক জনসনও বিচারকদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।
তবে, ট্রাম্প তার সিদ্ধান্তে অবিচল রয়েছেন বলেই মনে হয়। তিনি আদালতের রায় অনুসরণ করার কথা বললেও, বিচারকরা তার প্রশাসনকে সরকারি ব্যয় রোধ করতে বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এই ধরনের আচরণ বিচারকদের ‘শত্রু’ হিসেবে চিত্রিত করার একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ১৫ জন বিচারককে অভিশংসিত করা হয়েছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা