মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন দক্ষিণ কোরিয়া সফরের প্রাক্কালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে তার সম্ভাব্য বৈঠকের জল্পনা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। যদি এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়, তবে এটি হবে তাদের মধ্যেকার চতুর্থ শীর্ষ বৈঠক।
খবর সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর এই প্রথমবার ট্রাম্প এশিয়া সফরে যাচ্ছেন।
২০১৯ সালে ট্রাম্প যখন দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন, তখন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা পুনরায় শুরু করতে তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে উত্তর কোরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কিম জং উনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এবারও তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবার বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে অনেকেই মনে করছেন, ভবিষ্যতে যেকোনো সময় ট্রাম্প ও কিমের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। তাদের মতে, ২০১৯ সালের তুলনায় বর্তমানে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির বিস্তার ঘটেছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির প্রভাব বেড়েছে।
ট্রাম্প ইতোমধ্যেই কিমের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল বলে মন্তব্য করেছেন এবং তাকে ‘একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, কিম জং উনও ট্রাম্পের সঙ্গে তার ‘ব্যক্তিগত ভালো স্মৃতি’ রয়েছে বলে জানিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের ধারণা থেকে সরে আসলে আলোচনায় বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
যদিও অক্টোবরের ৩১ তারিখ থেকে নভেম্বরের ১ তারিখ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (এপেক) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ং উভয় পক্ষ থেকেই কোনো উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তবে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার একত্রীকরণ মন্ত্রী চুং ডং-ইয়ং আইনপ্রণেতাদের বলেছিলেন, মালয়েশিয়া ও জাপান সফরের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট দক্ষিণ কোরিয়া সফরকালে ডিমিলিটারাইজড জোনে ট্রাম্প ও কিমের মধ্যে আবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, কোরিয়া ন্যাশনাল ডিপ্লোম্যাটিক একাডেমির সহকারী অধ্যাপক বান কিল জু বলেছেন, “তাদের বৈঠকের সম্ভাবনা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।” তিনি সম্প্রতি বেসামরিক পর্যটকদের জন্য পানমুনজমের দক্ষিণাঞ্চলে ভ্রমণ স্থগিত এবং কিমের আলোচনার সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনের মন্তব্যকে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
যদি বৈঠকটি না হয়, তবে বান মনে করেন, আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে কিম সম্ভবত ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
২০১৯ সালের বৈঠকের মতো এবারও কোনো প্রস্তুতি এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সে সময় ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যা ছিল বেশ অপ্রত্যাশিত।
আগে উত্তর কোরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে ট্রাম্পের সঙ্গে কিমের আলোচনা ভেস্তে গিয়েছিল। এরপর থেকে কিম যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রের ভাণ্ডার বৃদ্ধি করেছেন। একইসঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছেন।
বর্তমানে কিমের কাছে আলোচনার জন্য আগের চেয়ে বেশি সুযোগ রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কিম সম্ভবত চান, যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিক। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দীর্ঘদিনের অবস্থান হলো, উত্তর কোরিয়া যদি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ না করে, তাহলে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার ক্যুং হী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক গবেষণা বিভাগের প্রাক্তন ডিন চুং জিন-ইয়ং বলেছেন, “যদি কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠক হয়, তাহলে ট্রাম্প এর কৃতিত্ব নেবেন এবং কোরীয় উপদ্বীপের সমস্যা সমাধানে তিনিই যে একমাত্র ব্যক্তি, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন। তবে এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র কিম জং উনকে দেওয়ার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু পাবে কি?”
দক্ষিণ কোরিয়ার ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কো ইউ-হাওয়ান বলেছেন, এপেক সম্মেলনের সময় ট্রাম্প ও কিমের মধ্যে কোনো বৈঠক হলে তা থেকে ফলপ্রসূ কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কিমকে আলোচনায় ফেরাতে ট্রাম্পকে এবার এমন কিছু প্রস্তাব করতে হবে, যা তাকে আকৃষ্ট করবে।
এমনকি যদি এ মাসে তাদের মধ্যে বৈঠক নাও হয়, তবুও ট্রাম্প ও কিমের মধ্যে ভবিষ্যতে আলোচনা শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। কিম সম্ভবত ট্রাম্পকে একজন বিরল মার্কিন নেতা হিসেবে বিবেচনা করেন, যিনি পারমাণবিক রাষ্ট্র হিসেবে উত্তর কোরিয়ার স্বীকৃতি দিতে পারেন। অন্যদিকে, ট্রাম্প মনে করেন, কিমের সঙ্গে বৈঠক তার জন্য কূটনৈতিক সাফল্য বয়ে আনবে।
ট্রাম্প ও কিমের মধ্যে সম্ভাব্য সংলাপ নিয়ে যেমন আশা রয়েছে, তেমনি কিছু উদ্বেগও রয়েছে। কেউ কেউ উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ কমাতে আলোচনার ওপর জোর দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ সতর্ক করে বলছেন, উত্তর কোরিয়া যদি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা বন্ধ করে, তাহলে এর বিনিময়ে দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হতে পারে। এমনটা হলে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য তা উদ্বেগের কারণ হবে।
ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের আরেক প্রাক্তন প্রধান কিম তাই-উ বলেছেন, “এমন সামান্য চুক্তি” এখনো দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তার জন্য উপকারী হবে। কারণ উত্তর কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা তেমন কোনো ফল দেয়নি।
কিম তাই-উ আরও বলেন, “যদি উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আঘাত হানতে সক্ষম হয়, তবে উত্তর কোরিয়া যদি দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর হামলা চালায়, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র তার বর্ধিত প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে?”
প্রাক্তন অধ্যাপক চুং মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি ত্যাগ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে তিনি বলেছেন, আংশিকভাবে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে নিষেধাজ্ঞার ছাড় দিলে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানেও তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দাবি উঠতে পারে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস