লিবিয়ায় অভিবাসীদের নির্বাসন পরিকল্পনার খবর : মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়ঙ্কর চিত্র।
কায়রো (এপি) – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লিবিয়ায় অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে দেশটিতে, যা অভিবাসীদের জন্য এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
সেখানকার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে তাদের ওপর চলছে নানা ধরনের নিপীড়ন।
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) খবর অনুযায়ী, লিবিয়ায় অভিবাসীদের প্রায়ই আটক করা হয় এবং তাদের রাখা হয় অত্যন্ত খারাপ পরিবেশে।
সেখানে তাদের ওপর চলে অত্যাচার, ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনা। জাতিসংঘের সমর্থনপুষ্ট একটি স্বাধীন অনুসন্ধানী দল প্রমাণ পেয়েছে যে লিবিয়ায় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের দাসত্বের শিকার হতে হয়েছে, তাদের জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে এবং হত্যা করা হয়েছে। দেশটির বিভিন্ন গণকবরে মৃত অভিবাসীদের লাশ পাওয়া গেছে।
এছাড়া, হাজার হাজার মানুষ লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় ডুবে মারা গেছে।
ইউরোপীয় কাউন্সিলের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক সিনিয়র ফেলো তারেক মেগেরিছি (Tarek Megerisi) এই পরিস্থিতিকে ‘পৃথিবীর নরক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তার মতে, অভিবাসীদের কেবল বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তিনি আরও বলেন, “ভাগ্য ভালো হলে তারা হয়তো একটা নড়বড়ে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাতে পারে।”
২০১১ সালে মোয়াম্মার গাদ্দাফির (Moammar Gadhafi) শাসনের পতনের পর লিবিয়ায় চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
দেশটির পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহী মিলিশিয়াদের সমর্থনপুষ্ট একটি সরকার এবং পশ্চিমাঞ্চলে ত্রিপোলি ভিত্তিক আরেকটি সরকারের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়।
মেগেরিছি আরও জানান, “তাদের প্রধান ব্যবসা হল মানব পাচার, এবং এটি তাদের ব্যবসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অভিবাসন বিষয়ক কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা অস্বীকার করেছে ত্রিপোলি-ভিত্তিক প্রধানমন্ত্রী আব্দুল হামিদ দবেইবাহের (Abdul Hamid Dbeibah) সরকার এবং পূর্বাঞ্চলে সামরিক কমান্ডার খলিফা হাফতারের (Khalifa Hifter) নেতৃত্বাধীন প্রশাসন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে, লিবিয়ায় প্রায় আট লাখ অভিবাসী কাজ ও যুদ্ধের কারণে নিজেদের দেশ ছেড়ে এসেছে।
প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ উত্তর আফ্রিকা থেকে ইউরোপে যাওয়ার জন্য এই বিপজ্জনক সমুদ্রপথ পাড়ি দেয়।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সত্ত্বেও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) এবং ইতালি (Italy) দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠীকে অর্থ, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে, যাদের মধ্যে কোস্ট গার্ডও রয়েছে।
তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিবাসীদের ইউরোপে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া।
লিবিয়ায় আটক কেন্দ্রগুলোতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা অভিবাসীদের ওপর নির্যাতন ও তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের ঘটনা ঘটে।
‘লয়ার্স ফর জাস্টিস ইন লিবিয়া’র (Lawyers for Justice in Libya) প্রোগ্রাম লিড মেহদি বেন ইউসুফ (Mehdi Ben Youssef) জানান, হয় সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্ত, না হয় স্বাধীন, এমন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অভিবাসীদের আটক করে এবং নির্যাতন চালায়।
এরপর মুক্তি পাওয়ার পরও তাদের অন্য একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আবার ধরে নিয়ে যায়।
বেন ইউসুফ আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যারা লিবিয়ায় ফেরত যেতে বাধ্য হবেন, তাদের অপরাধের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে অভিবাসীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় এবং তাদের ‘ভয়াবহ পরিস্থিতিতে’ রাখা হয়।
তাদের কোনো আইনি সহায়তা বা পর্যাপ্ত পানি ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। লিবিয়ার বাইরের পরিবারগুলোর কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাদের স্বজনদের নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেল করা হয়।
২০১৯ সালের একটি অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিবাসীদের অবস্থার উন্নতির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ মিলিশিয়া, পাচারকারী এবং কোস্ট গার্ড সদস্যদের হাতে চলে যায়।
গত মাসে, লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা ১০টি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাকে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করার নির্দেশ দেয়।
সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে স্থানীয় আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগ ছিল, তারা আফ্রিকান অভিবাসীদের সাহায্য করছে এবং একটি ‘প্রতিস্থাপন’ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রচার করছে।
এর ফলে কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসীদের ওপর আরও বেশি হামলা হচ্ছে।
চিকিৎসকবিহীন সীমান্ত (Doctors Without Borders) নামক একটি সংগঠনের লিবিয়ার প্রোগ্রাম প্রধান ক্লদিয়া লোডেসানি (Claudia Lodesani) জানান, লিবিয়া অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ দেশ নয় এবং এই ধরনের নির্দেশ পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ কিছু অভিবাসীকে লিবিয়ায় ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এর মাধ্যমে একটি ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে লিবিয়া নিরাপদ, অথচ তা মোটেও সত্য নয়।
বর্তমানে, লিবিয়ায় অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
একজন মার্কিন বিচারক জানিয়েছেন, এই ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করার সুযোগ না দিয়ে কাউকে নির্বাসন দেওয়া যাবে না।
মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউট থিংক ট্যাংকের ইউরোপীয় শাখার প্রধান ক্যামিল লে কোজ (Camille Le Coz) বলেন, “লিবিয়ার শরণার্থী গ্রহণের প্রক্রিয়া খুবই কঠিন।
তারা কেবল কয়েকটি দেশের শরণার্থীদের স্বীকৃতি দেয়।”
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (Associated Press)