মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির চাপে এশীয় দেশগুলো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনতে চাইছে, যা তাদের জলবায়ু লক্ষ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে। সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ রয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবং শুল্কের চাপ এড়াতে এশীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এলএনজি কেনার প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে ভিয়েতনাম, জাপান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও ভারতের মতো দেশগুলো উল্লেখযোগ্য। বিশ্লেষকদের মতে, স্বল্পমেয়াদে এটি হয়তো কিছু সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশগুলোর প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে এবং তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
এলএনজি, বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, হলো প্রাকৃতিক গ্যাসকে শীতল করে তরল অবস্থায় রূপান্তর করে সংরক্ষণ ও পরিবহনের একটি প্রক্রিয়া। এটি মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন, আবাসিক রান্নার গ্যাস এবং শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হয়। এলএনজি কয়লার চেয়ে কম কার্বন নিঃসরণ করে, তবে এটি এখনো একটি জীবাশ্ম জ্বালানি, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে সহায়তা করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলএনজি চুক্তিতে আবদ্ধ হলে এশীয় দেশগুলোতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির কারণে দেশগুলো পুরনো অবকাঠামোতে আটকা পড়ে যেতে পারে, যখন বিশ্ব দ্রুত সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের মতো পরিষ্কার শক্তির দিকে ঝুঁকছে। এই ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতের জন্য ব্যয়বহুল এবং পরিবর্তন করা কঠিন।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এশীয় দেশগুলোতে এলএনজি বিক্রির প্রচেষ্টা নতুন নয়, তবে বাণিজ্য চুক্তি জেতার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের জোর প্রচেষ্টার কারণে এটি আরও গতি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জাপান সম্প্রতি ২০৩০ সাল থেকে শুরু করে প্রতি বছর ৫.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন মার্কিন গ্যাস কেনার জন্য দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
তবে, এলএনজি আমদানি করে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কোরিয়াকে যদি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে হয়, তবে বছরে ১২১ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি আমদানি করতে হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গত বছরের মোট রপ্তানির চেয়ে বেশি। এছাড়া, প্রস্তাবিত আলাস্কা এলএনজি প্রকল্প এখনো অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়।
দীর্ঘমেয়াদী মার্কিন এলএনজি চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া আঞ্চলিক জ্বালানি নিরাপত্তাকেও প্রভাবিত করতে পারে। জ্বালানি নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হয়, যখন জ্বালানি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হয়। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং হরমুজ প্রণালীতে জ্বালানি সরবরাহে সম্ভাব্য বিঘ্ন ঘটার কারণে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এশীয় দেশগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে মনোযোগ দিয়ে তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা বাড়াতে পারে এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, যা এখনো সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানো হয়নি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বৈশ্বিক এলএনজি বাজারের এই পরিবর্তনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানির ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তাই, এলএনজি বাজারের এই অস্থিরতা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও মূল্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। একইসঙ্গে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশে আমাদের আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করবে।
তথ্য সূত্র: আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম।