যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প উৎপাদন পুনরুজ্জীবিত করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা, কতটা বাস্তব?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো, দেশটির উৎপাদন শিল্পকে (manufacturing sector) আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা। এর জন্য তিনি শুল্ক (tariff) আরোপের পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাজটি সহজ নয়।
কারণ, প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং শ্রমশক্তির দক্ষতা এই চ্যালেঞ্জকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
১৯৭০ সালে, আমেরিকার মোট শ্রমশক্তির ২৫ শতাংশ কাজ করতেন উৎপাদন শিল্পে। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশে। ট্রাম্প মনে করেন, বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক বসালে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে।
তিনি চান, একসময় আমেরিকার সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে ওঠা কারখানাগুলো আবার চালু হোক, শ্রমিকেরা কাজে ফিরুক। বিশেষ করে, দেশটির ‘রাস্ট বেল্ট’ হিসেবে পরিচিত ডেট্রয়েট এবং মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলের কারখানাগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চান তিনি।
কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেক বদলে গেছে। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কারখানায় মানুষের বদলে রোবট ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে, নতুন কারখানা তৈরি হলেও সেখানে আগের মতো বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন হবে না।
এই পরিবর্তনের কারণে, এখন প্রয়োজন বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্ক নীতি হয়তো কিছু ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত করবে। তবে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে কর্মীদের আধুনিক কারখানায় কাজের উপযোগী করে তোলা।
তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং এই খাতে কাজ করতে আগ্রহী করে তোলাই এখন প্রধান বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রে একসময় উৎপাদন শিল্পের জয়জয়কার ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটি এই খাতে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু গত ৫০ বছরে, অনেক উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে বা অন্য দেশে চলে গেছে।
এর ফলে, দেশটির অনেক অঞ্চলের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার উৎপাদন খাতের এই দুর্বলতা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, বিদেশি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের কাজ কেড়ে নিয়েছে। তাই, তিনি বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এই শুল্কের হার ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে, কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি।
তবে, অনেকের মতে, শুধু শুল্ক আরোপ করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কারণ, কারখানার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পেছনে বহিরাগমন (outsourcing) এর চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে প্রযুক্তি।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মীর অভাব রয়েছে। ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, সেখানে প্রায় ৪ লক্ষ ৮২ হাজার শূন্যপদ ছিল, যা পূরণ হয়নি। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ম্যানুফ্যাকচারার্স (NAM) ধারণা করছে, ২০২৩ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ১৯ লাখে পৌঁছাতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক উৎপাদন খাতে কাজ করতে হলে কর্মীদের সফটওয়্যার, ডেটা অ্যানালিটিক্স (data analytics) এবং কোডিংয়ের মতো বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে। এছাড়া, কারখানার রোবট মেরামতের জন্য দক্ষ কর্মীরও প্রয়োজন হবে।
অন্যদিকে, সমালোচকরা বলছেন, শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়বে, যা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সমস্যা তৈরি করবে।
ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) আসার কারণে অনেক শিল্পে কাজের ধরন পরিবর্তন হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৪১ শতাংশ কোম্পানি কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করছে, কারণ এআই অনেক কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে পারবে।
এই পরিস্থিতিতে, কর্মীদের নতুন দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। সেইসঙ্গে, প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোন ধরনের কাজের সুযোগ তৈরি হবে, সে বিষয়েও ধারণা রাখতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য এর প্রাসঙ্গিকতা:
যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশও শিক্ষা নিতে পারে। আমাদের দেশেও তৈরি পোশাক (RMG) সহ বিভিন্ন শিল্পখাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়ছে।
তাই, কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। একইসঙ্গে, বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন