ট্রাম্পের ব্যবসা: মধ্যপ্রাচ্যে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, গলফ কোর্স আর ক্রিপ্টোকারেন্সি!

ট্রাম্প পরিবারের মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা প্রসারের নতুন চিত্র: স্বার্থের সংঘাতের আশঙ্কা।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবারের ব্যবসা মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী, তার প্রথম মেয়াদের তুলনায় এই অঞ্চলের সঙ্গে ট্রাম্প পরিবারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক তিনগুণের বেশি বেড়েছে।

বিলাসবহুল আকাশচুম্বী অট্টালিকা, গলফ খেলার মাঠ এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি-সংক্রান্ত নানা চুক্তির মাধ্যমে এই অঞ্চলে নিজেদের ব্যবসার জাল বিস্তার করছেন তারা।

ট্রাম্প পুনরায় হোয়াইট হাউজে ফেরার পর তার এই পদক্ষেপ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট এবং একজন ব্যবসায়ীর ভূমিকা পালন করা কতটা সঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

কারণ, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে ট্রাম্প পরিবারের ব্যক্তিগত লাভক্ষতির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্পের এই ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিদেশি শক্তিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রভাবিত করার সুযোগ করে দিতে পারে। তারা বলছেন, ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তিনি প্রকাশ্যে তার ব্যবসায়িক স্বার্থকে উৎসাহিত করেছেন।

এমনকি ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক দিন আগে তিনি একটি মেম কয়েন চালু করেন, যার মূল্য বাড়ে যখন তিনি কয়েনের শীর্ষ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত নৈশভোজে অংশ নেন।

ট্রাম্প অবশ্য বরাবরই ব্যবসার প্রতি তার আগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন। সৌদি আরবের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল দ্বারা আয়োজিত একটি সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সবসময় টাকা বানানোর একটা উপায় খুঁজে বের করি।’

ওই অনুষ্ঠানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে তুলে ধরেন এবং একইসঙ্গে তার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক সাফল্যের কথাও উল্লেখ করেন।

মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের বিভিন্ন প্রকল্প, যার মধ্যে অনেকগুলোর ঘোষণা দেওয়া হলেও এখনো নির্মাণকাজ শুরু হয়নি, মূলত বিদেশি ডেভেলপারদের সঙ্গে লাইসেন্স চুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।

তারা ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ‘ট্রাম্প’ নাম ব্যবহারের জন্য অর্থ পরিশোধ করে।

অতীতে, অনেক প্রেসিডেন্ট তাদের ব্যবসার সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত এড়াতে তা হয় বিক্রি করে দিয়েছেন, না হয় ‘ blind trust’-এর অধীনে রেখেছেন।

ট্রাম্প এক্ষেত্রে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন। তার সম্পদ তার সন্তানদের দ্বারা পরিচালিত একটি ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে। ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট এরিক ট্রাম্প বলেছেন, ব্যবসার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট অফিসের কোনো সম্পর্ক থাকবে না, যাতে কোনো ধরনের নৈতিক সংঘাত এড়ানো যায়।

যদিও ট্রাম্প অর্গানাইজেশন দ্বিতীয় মেয়াদে বিদেশি সরকারগুলোর সঙ্গে কোনো নতুন চুক্তি করবে না বলে ঘোষণা করেছে, তবে কাতারভিত্তিক একটি কোম্পানির সঙ্গে ট্রাম্প-ব্র্যান্ডের একটি গলফ মাঠ নির্মাণের চুক্তি হয়েছে।

এই চুক্তিতে কাতারের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল ‘কাতার দিয়ার’-এর সমর্থন রয়েছে।

কাতার সরকারের এক মন্ত্রী জানান, এই চুক্তির মাধ্যমে তারা কাতারকে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে আরও শক্তিশালী করতে চান। এরিক ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেছেন, তারা কাতার দিয়ার এবং একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ‘ডার গ্লোবাল’-এর মাধ্যমে কাতারে ‘ট্রাম্প ব্র্যান্ড’ প্রসারিত করতে পেরে অত্যন্ত গর্বিত।

তবে ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাদের কোম্পানির কাতার দিয়ার বা কাতার সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। তাদের চুক্তি মূলত ডার গ্লোবালের সঙ্গে।

মুখপাত্রের দাবি, ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন কোনো সরকারি সংস্থার সঙ্গে ব্যবসা করে না।’

ট্রাম্প বিভিন্ন সময় উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন। তার প্রশাসন এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের (United Arab Emirates – UAE) প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পেরেছে।

এছাড়া, সৌদি আরবও চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ৬০০ বিলিয়ন ডলার বাড়ানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এমনকি, ট্রাম্প সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্রে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে সমালোচকরা বলছেন, ট্রাম্প এবং তার ব্যবসার এই পদক্ষেপগুলো প্রমাণ করে যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সুবিধা নিতে আগ্রহী। তাদের আশঙ্কা, বিদেশি কর্মকর্তারা তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য ট্রাম্পকে সহযোগিতা করতে পারেন।

হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট অবশ্য প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত ব্যবসা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নিজের সুবিধার জন্য কিছু করছেন, এমন ধারণা করাটা হাস্যকর। এই হোয়াইট হাউস সর্বোচ্চ নৈতিক মান বজায় রাখে।’

২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি, ট্রাম্পের সমর্থকরা ইউএস ক্যাপিটলে হামলা চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক মহলে ট্রাম্প একরকম একঘরে হয়ে পড়েন। এমনকি, কিছু সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম তাকে নিষিদ্ধ করে এবং তার প্রচারণা বিষয়ক ওয়েবসাইটের জন্য পেমেন্ট প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় একটি সফটওয়্যার কোম্পানি।

তবে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু ব্যবসায়ী ট্রাম্পের পাশে ছিলেন। দুবাইয়ে ট্রাম্পের একটি গলফ মাঠ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডামাক প্রপার্টিজ’-এর প্রধান হুসেইন সাজওয়ানি ৬ই জানুয়ারির ঘটনার এক সপ্তাহ পরেই তাদের সম্পর্ক আরও বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন।

এরপর থেকেই ওই অঞ্চলে ট্রাম্প পরিবারের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হতে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংবাদমাধ্যম জানায়, সৌদি আরবের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল, যা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) নেতৃত্বে পরিচালিত হয়, ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের (Jared Kushner) একটি প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্মে ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

কুশনার এবং এমবিএসের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যখন কুশনার ট্রাম্পের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কুশনার হোয়াইট হাউজে ফিরবেন না বললেও, একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তিনি এখনো আরব নেতাদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন।

ওমানের সরকারও একটি ট্রাম্প-ব্র্যান্ডের রিসোর্ট, ভিলা এবং গলফ ক্লাব নির্মাণের জন্য অংশীদারিত্ব করেছে। গত গ্রীষ্মে এরিক ট্রাম্প এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র এই যৌথ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।

যদিও এসব চুক্তি ট্রাম্পের ক্ষমতা ছাড়ার সময়ে হয়েছে, তবে নভেম্বরে তার জয়ের পর এই অঞ্চলে তার ব্যবসার প্রসার আরও বেড়েছে।

ডার গ্লোবাল, যারা ওমানের প্রকল্পটি তৈরি করছে, সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে আরও দুটি প্রকল্প এবং কাতারে গলফ ক্লাব নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। ডার গ্লোবালের মূল কোম্পানি, যা রিয়াদে অবস্থিত, সৌদি যুবরাজের আধুনিকায়নের পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ডার গ্লোবালের সিইও জিয়াদ এল-চার সম্প্রতি দুবাইতে একটি প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ট্রাম্প ব্র্যান্ডের ওপর বিশ্বাস হারাবেন না।’ এরিক ট্রাম্পও উল্লেখ করেছেন যে, তার সংস্থা ডার গ্লোবালের সঙ্গে ‘অনেকগুলো প্রকল্প’ করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কিছু আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

সম্প্রতি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ‘সত্য সামাজিক’ পোস্টে (Truth Social Post) জানান, তিনি নতুন এয়ার ফোর্স ওয়ান বিমান বিনামূল্যে গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

সূত্রমতে, কাতার রাজপরিবার থেকে বিমানটি দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে কাতারের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিমানটি কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পেন্টাগনকে উপহার হিসেবে দেওয়া হবে।

এরপর পেন্টাগন এটি প্রেসিডেন্টের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত করে তুলবে।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন কোম্পানিও ট্রাম্পের ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফাইনান্সিয়াল’-কে সহায়তা করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত-ভিত্তিক ‘ডিডব্লিউএফ ল্যাবস’ (DWF Labs) সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে তারা সংস্থাটির টোকেন কিনেছে ২৫ মিলিয়ন ডলারের।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *