শিরোনাম: কয়লা নিয়ে ট্রাম্পের মিথ্যাচার: যুক্তরাষ্ট্রের নীতির প্রভাব ও বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়লা শিল্পের প্রসারের জন্য নতুন করে কিছু নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে রক্ষা করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়লা খনি লিজের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে চাইছেন।
তবে, কয়লার সুবিধাগুলো তুলে ধরতে গিয়ে তিনি এর নিরাপত্তা এবং ব্যবহারের বিভিন্ন দিক নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে, ট্রাম্পের দেওয়া কিছু তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হলো।
ট্রাম্পের প্রথম দাবি ছিল, “আমি এটিকে সুন্দর, পরিচ্ছন্ন কয়লা বলি। আমি আমার লোকজনকে বলেছি, কয়লা শব্দটি ব্যবহারের আগে অবশ্যই ‘সুন্দর, পরিচ্ছন্ন’ শব্দ দুটি ব্যবহার করতে হবে।”
বাস্তবতা: কয়লা উৎপাদন বর্তমানে অতীতের তুলনায় কিছুটা পরিচ্ছন্ন হয়েছে, তবে এর অর্থ এই নয় যে এটি সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের (ইআইএ) তথ্য অনুযায়ী, কয়লা শিল্পের কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ গত ৩০ বছরে হ্রাস পেয়েছে।
তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে কয়লা উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো জরুরি। কয়লা পোড়ানোর ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গত হয়, যা অ্যাসিড বৃষ্টি, বায়ু দূষণ এবং শ্বাসকষ্টের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুতের জন্য কয়লার ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যার প্রধান কারণ হলো প্রাকৃতিক গ্যাসের দিকে পরিবর্তন। একসময় দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি আসতো কয়লা থেকে, যা ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৫ শতাংশ ছিল।
বর্তমানে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশে। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রায় ৪৩ শতাংশ বিদ্যুতের যোগান দেয়। অবশিষ্ট বিদ্যুৎ আসে পারমাণবিক শক্তি এবং বায়ু, সৌর ও জলবিদ্যুৎ-এর মতো নবায়নযোগ্য উৎস থেকে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় দাবি ছিল, “কয়লা সস্তা, অত্যন্ত কার্যকর, উচ্চ ঘনত্বের এবং প্রায় ধ্বংস করা যায় না।”
বাস্তবতা: নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে কয়লা সবচেয়ে ব্যয়বহুল। ইআইএ-এর অনুমান অনুযায়ী, নতুন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টা প্রায় ৯০ মার্কিন ডলারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
অথচ, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে কোনো কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেই।
অন্যদিকে, ব্যাটারিবিহীন সৌরবিদ্যুৎ নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে সস্তা উৎস। এই ক্ষেত্রে, নতুন প্রকল্পের জন্য প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টা প্রায় ২৩ মার্কিন ডলার খরচ হয়।
এখানে উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’-এর অধীনে কর ছাড় ও অন্যান্য ভর্তুকি নবায়নযোগ্য জ্বালানির খরচ কমাতে সাহায্য করে। নতুন প্রাকৃতিক গ্যাস কেন্দ্রগুলো প্রায় ৪৩ মার্কিন ডলারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।
এনার্জি ইনোভেশন নামের একটি নিরপেক্ষ জলবায়ু নীতি থিংক ট্যাংক খুঁজে পেয়েছে যে, বিদ্যমান ৯৯ শতাংশ মার্কিন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থানীয় সৌর, বায়ু ও ব্যাটারি স্টোরেজ দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে তা চালু রাখার চেয়ে বেশি সাশ্রয়ী হবে।
ট্রাম্পের তৃতীয় দাবি: “আমাদের দেশের অব্যবহৃত কয়লার মূল্য ফোর্ট নক্সে মজুত সোনার মূল্যের ১০০ গুণ বেশি।”
বাস্তবতা: যদিও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর পরিমাণে কয়লা মজুদ আছে, তবে এর আনুমানিক মূল্য ট্রাম্পের দাবির মতো এত বেশি নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ফোর্ট নক্সে প্রায় ১৪৭.৩ মিলিয়ন ট্রয় আউন্স সোনা মজুদ আছে, যার হিসাব অনুযায়ী মূল্য প্রায় ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
মঙ্গলবার (স্থানীয় সময়) বাজারে সোনার প্রতি ট্রয় আউন্সের দাম ছিল ২,৯৯০.২০ মার্কিন ডলার, যা বাজারমূল্যে প্রায় ৪৪০.৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, ইআইএ-এর হিসাব অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি, ২০২৪ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভে প্রায় ৪৬৯.১ বিলিয়ন শর্ট টন কয়লা ছিল, যার মধ্যে প্রায় ৫৩ শতাংশ উত্তোলনের উপযুক্ত।
ইআইএ-এর মতে, এর মূল্য প্রায় ৫৯৮.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি ফোর্ট নক্সের সোনার চেয়ে বেশি, তবে ট্রাম্পের দাবির মতো ১০০ গুণ বেশি নয়।
ট্রাম্পের চতুর্থ দাবি: “জার্মানিতে সর্বত্র কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হচ্ছে।”
বাস্তবতা: এটি সঠিক নয়। জার্মানির অর্থনীতি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১৮টি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “নতুন কোনো কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে না।” জার্মানি ২০২৮ সালের মধ্যে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে।
তবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে জার্মানি ২০২২ ও ২০২৩ সালে কিছু কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনরায় চালু করেছিল। তারা সীমিত সময়ের জন্য প্রায় ৬ গিগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনরায় চালু করার অনুমতি দিয়েছিল। এগুলি ২০২৪ সালের মার্চের শেষ নাগাদ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কয়লার ব্যবহার কমানো এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে মনোনিবেশ করা বাংলাদেশের জন্য টেকসই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস