মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের দাম বাড়তে পারে এবং সরবরাহ কমে যেতে পারে। এমনটাই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খুব শীঘ্রই ঔষধ আমদানির ওপর বড় ধরনের শুল্ক আরোপের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ উৎপাদন বাড়বে। একইসঙ্গে অন্য দেশগুলোতে ওষুধের কম দামের বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনটা হলে রোগীদের জন্য ওষুধের দাম আরও বাড়তে পারে এবং বাজারে ওষুধের সংকট আরও বাড়তে পারে। ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়াতে আগ্রহী হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। উৎপাদন বাড়লেও কয়েক বছর পর্যন্ত এর ফল পাওয়া যাবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিকের সংকট একটি গুরুতর সমস্যা। আমেরিকান সোসাইটি অফ হেলথ-সিস্টেম ফার্মাসিস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালসহ প্রায় ৪০টির বেশি ওষুধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বর্তমানে যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর সংকট চলছে, তার মধ্যে রয়েছে- অ্যামোক্সিসিলিন (গলা ও কানের সংক্রমণ) এবং পেনিসিলিন (সিফিলিস)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্ক আরোপ করা হলে এই সমস্যা আরও বাড়তে পারে। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রায় ৯০ শতাংশ ওষুধ তৈরি হয় জেনেরিক পদ্ধতিতে, যার কাঁচামাল আসে চীন ও ভারত থেকে। টম ক্রাউস, যিনি আমেরিকান সোসাইটি অফ হেলথ-সিস্টেম ফার্মাসিস্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট, তিনি বলেন, জেনেরিক ওষুধগুলোর দাম খুবই কম থাকে। এই ওষুধগুলোর উৎপাদন খরচ বাড়লে, তা বিক্রি করা লাভজনক নাও হতে পারে।
ইতিমধ্যেই হাসপাতালে জরুরি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ইনজেকশনযোগ্য ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে স্যালাইন বা ডেক্সট্রোজের মতো সাধারণ ইনজেকশনও রয়েছে। কম দাম এবং বাজারের অস্থিরতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে এগুলোর সংকট চলছে। ইউনিভার্সিটি অফ ইউটাহ হেলথের ওষুধ সংকট বিশেষজ্ঞ এরিন ফক্সের মতে, “কম মুনাফার কারণে কোম্পানিগুলো উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারে। ফলে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
বোস্টন ইউনিভার্সিটি কুইস্ট্রম স্কুল অফ বিজনেসের সহযোগী অধ্যাপক রেনা কন্টি জানান, প্রায় ৪০ শতাংশ জেনেরিক ওষুধের কাঁচামাল সরবরাহ করে মাত্র এক বা দুজন প্রস্তুতকারক। তাঁর মতে, “এই সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। যদি প্রস্তুতকারকদের একজনও উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, তবে বাজারে ওষুধের সংকট দেখা দেবে।
অন্যদিকে, যদি কোনো ওষুধের একমাত্র প্রস্তুতকারক থাকে, তবে প্রায়ই দাম বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, মার্টিন শ focusli নামের একজন ব্যক্তি এইচআইভি রোগীদের জন্য ব্যবহৃত একটি ওষুধের দাম ১৩.৫০ ডলার থেকে এক রাতেই ৭৫০ ডলারে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যদিও জনমত এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে এমন ঘটনা এখন কমে এসেছে, তবে এখনো মাঝে মাঝে এমনটা ঘটে।
তবে ব্রুকলিং সেন্টার অন হেলথ পলিসির সিনিয়র ফেলো ড. মার্তা ওসিনস্কা বলেছেন, জেনেরিক ওষুধ, বিশেষ করে ইনজেকশনযোগ্য ওষুধের দাম বাড়ানো প্রস্তুতকারকদের জন্য কঠিন হতে পারে। “এর একটি কারণ হল গ্রুপ পারচেসিং অর্গানাইজেশন (GPO) চুক্তি। হাসপাতালগুলো সাধারণত এই চুক্তির মাধ্যমে ইনপেশেন্ট সেটিংসে ব্যবহারের জন্য ইনজেকশনযোগ্য জেনেরিক ওষুধ সংগ্রহ করে থাকে। এই চুক্তিগুলোর মেয়াদ এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত হয়, যা দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে।
ফিনান্সিয়াল ফার্ম ফ্যালানক্স ইনভেস্টমেন্ট পার্টনার্সের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ডেভিড মারিসের মতে, “এমন কিছু আইন রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির চেয়ে দ্রুত দাম বাড়ানোকে কঠিন করে তোলে।
ব্র্যান্ডেড ওষুধের ক্ষেত্রে, যেখানে এখনো পেটেন্ট সুরক্ষা রয়েছে এবং জেনেরিক ওষুধের সঙ্গে প্রতিযোগিতা নেই, সেখানে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। মারিসের ধারণা, ব্র্যান্ডেড ওষুধের কাঁচামালের দাম মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশের মতো। তিনি আরও বলেন, “যদি এই ১০ শতাংশের দাম ৩৫ শতাংশ বাড়ে, তবে সামগ্রিকভাবে উৎপাদন ব্যয়ের ওপর এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম হবে।
তবে ব্র্যান্ডেড ওষুধের প্রস্তুতকারকদের দাম বাড়ানোর সুযোগ বেশি থাকলেও, তারা তা করবে না বলেই মনে করেন মারিস। তাঁর মতে, “এই খরচগুলো তারা গ্রাহকদের ওপর চাপাবে, যার ফলে ওষুধের দাম বাড়বে। বীমাকৃত রোগীদের ক্ষেত্রে এর অর্থ হল উচ্চ প্রিমিয়াম এবং সম্ভবত বেশি পকেট খরচ।
ইতিমধ্যেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ওষুধের দাম সবচেয়ে বেশি। ট্রাম্প অতীতেও এই বিষয়ে কথা বলেছেন এবং বর্তমানে ডেমোক্রেট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের সঙ্গে তাঁর এই বিষয়ে মিল রয়েছে। রোগী অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘পেশেন্টস ফর অ্যাফোর্ডেবল ড্রাগস’-এর নির্বাহী পরিচালক মেরিথ বেসি বলেন, “শুল্ক এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। প্রেসক্রিপশন ওষুধ কোনো বিলাসবহুল পণ্য নয়, বরং মানুষের স্বাস্থ্য ও survival-এর জন্য অপরিহার্য।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বল্প মেয়াদে ওষুধের সংকট বাড়তে পারে এবং দামও বাড়তে পারে। তবে শুল্ক আরোপের মূল উদ্দেশ্য যে ওষুধ উৎপাদন পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এদিকে, কিছু মার্কিন ওষুধ কোম্পানি এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফেব্রুয়ারিতে এলি লিলি ঘোষণা করেছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রে আরও চারটি উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করতে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
তবে নতুন কারখানা তৈরি করতে বা নতুন উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে কয়েক বছর সময় লাগে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো জরুরি, তবে তাঁরা মনে করেন, শুল্ক আরোপ করে এই লক্ষ্য অর্জন করা যাবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন