বদলে গেল দুনিয়া! ট্রাম্প আর পোপের হাতে ক্ষমতার লড়াই?

নতুন বিশ্বে পরাক্রমশালী দুই মার্কিন: ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পোপ লিও

বিশ্ব মঞ্চে এখন দুই প্রভাবশালী মার্কিনির আগমন ঘটেছে—একজন হলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, এবং অন্যজন হলেন সম্প্রতি নির্বাচিত পোপ লিও চতুর্দশ। তাঁদের ভিন্ন ভূমিকা এবং কর্মক্ষেত্রের কারণে তাঁদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক।

এই দুই প্রভাবশালী ব্যক্তির নেতৃত্ব দেওয়ার ধরনের ভিন্নতা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।

পোপ লিও চতুর্দশ, যিনি আগে কার্ডিনাল রবার্ট এফ. প্রিভোস্ট নামে পরিচিত ছিলেন, গত সপ্তাহে বিশ্বের ১.৪ বিলিয়ন ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর এই নির্বাচন প্রমাণ করে, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মধ্যে দুইজনই এখন মার্কিন নাগরিক।

এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটল, যখন ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ‘একতরফা’ নীতির কারণে বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মিত্র দেশগুলোর মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ক্যাথলিক চার্চের ইতিহাসে আগে কোনো আমেরিকানকে পোপ হিসেবে নির্বাচিত না করার পেছনে সম্ভবত একটি কারণ ছিল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা। তবে, বর্তমানে সেই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে।

ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটির সেন্টার অন রিলিজিয়ন অ্যান্ড কালচারের পরিচালক ডেভিড গিবসন মনে করেন, “পোপ লিও’র নির্বাচন অনেকের কাছে আশার আলো হিসেবে দেখা দেবে। কারণ, তিনি একজন আমেরিকান হয়েও তাঁদের (অন্যান্য দেশের) হয়ে কথা বলতে পারবেন।”

পোপ লিও’র এই নির্বাচনের পর বিশ্বজুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, যেখানে শীর্ষস্থানীয় দুটি পদে একই দেশের মানুষের অধিষ্ঠান নিয়ে জল্পনা চলছে। ট্রাম্প সাধারণত তাঁর কর্তৃত্ব ভাগ করে নিতে পছন্দ করেন না।

তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ পররাষ্ট্রনীতি তারই প্রমাণ। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথলিকদের একটি অংশ ট্রাম্পকে সমর্থন করে, ট্রাম্পের একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ অনেককে হতাশ করেছে।

প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের শোকের দিনে ট্রাম্প নিজের একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন, যেখানে তাঁকে পোপের বেশে দেখা যায়। এই বিষয়টি অনেকের কাছে ভালো লাগেনি।

যদিও ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই ছবি তিনি পোস্ট করেননি এবং যারা এতে আপত্তি করেছেন, তারা ‘কৌতুক’ বুঝতে পারেননি।

অন্যদিকে, পোপ লিও’ও একজন রাজনীতিকের মতোই কাজ করেন। জানা যায়, তিনি নির্বাচনের আগে ছোট ছোট দলে কার্ডিনালদের সঙ্গে কথা বলেছেন। শিকাগোতে জন্ম নেওয়া লিও, পেরুতে প্রায় দুই দশক মিশনারি হিসেবে কাজ করেছেন।

এর পরে, ২০২৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাঁকে ভ্যাটিকানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন, যেখানে তিনি বিশ্বজুড়ে বিশপদের কার্যক্রম তদারকি করতেন।

পোপ দ্বিতীয় জন পলের মতো, পোপ লিও’ও বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। দ্বিতীয় জন পোল কমিউনিজম পতনে সাহায্য করেছিলেন। তবে পোপ লিও এরই মধ্যে মার্কিন রাজনীতিক জেডি ভ্যান্সের সমালোচনা করেছেন।

অভিবাসন ও পরিবেশের মতো নীতিগত বিষয়েও তাঁর সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের মতবিরোধ রয়েছে।

গণমাধ্যমের প্রতিও পোপ লিও’র মনোযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ভ্যাটিকান সিটিতে তিনি কারারুদ্ধ সাংবাদিকদের মুক্তি এবং বাকস্বাধীনতারক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে, সাংবাদিকদের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক বরাবরই বৈরী ছিল।

পোপ লিও এবং ট্রাম্প—উভয়েই ভিন্ন পথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ক্যাথলিক থিওলজিক্যাল ইউনিয়নের বার্নার্ডিন সেন্টারের পরিচালক স্টিভেন মিলিস মনে করেন, ধর্ম ও রাজনীতি দুটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় এবং তাদের মধ্যে মিল খুঁজে বের করা কঠিন।

তিনি আরও বলেন, “পোপ ফ্রান্সিস এবং কার্ডিনাল প্রিভোস্ট—উভয়েই ছিলেন যাজক, যিনি বাইবেলের শিক্ষা দিয়েছেন এবং দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার কথা বলেছেন। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট, রিয়েলিটি টিভি তারকা বা ব্যবসায়ী হিসেবে সেই ধরনের কোনো ভূমিকা নেই।”

পোপ লিও’র বিশ্বদৃষ্টি কেমন?

পোপ লিও’র পেরুতে কাটানো কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা তাঁকে মানবতা, ক্ষমতা, ধর্ম ও রাজনীতির বিষয়ে গভীর ধারণা দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের থেকে তাঁর নেতৃত্বের ধরন ভিন্ন হবে।

সম্ভবত তিনি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত মানুষের প্রতি বেশি মনোযোগ দেবেন। এমনকি নিজের প্রথম ভাষণেও তিনি আমেরিকান পরিচয় দেননি এবং ইংরেজি ভাষায় কথা বলেননি, যা তাঁর বিশ্বব্যাপী অগ্রাধিকারের ইঙ্গিত দেয়।

হার্ভার্ড ডিভিনিটি স্কুলের অধ্যাপক রাউল জেগারার মতে, “যদিও পোপ লিও একজন মার্কিন নাগরিক, তবে তাঁকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর ধারণার পরিবর্তে, আমেরিকার বৃহত্তর অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা উচিত। তাঁর নেতৃত্ব সংঘাতের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে এবং আধিপত্যের পরিবর্তে সেবার মাধ্যমে ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর ইঙ্গিত দেয়।

বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির গভীর পার্থক্য রয়েছে।

অন্যদিকে, কিছু আমেরিকান কার্ডিনাল মনে করেন, পোপ লিও’র মধ্যে আমেরিকান মানসিকতার প্রতিফলন খুব কম দেখা যায়। তাঁরা এটাও মনে করেন, তাঁর পোপ নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকান পরিচয় কোনো ভূমিকা রাখেনি। তবে ট্রাম্পের উপস্থিতি সেখানে ছিল।

কনক্লেভে অংশ নেওয়া ছয়জন আমেরিকান কার্ডিনাল ‘বর্ন ইন দ্য ইউএসএ’ এবং ‘আমেরিকান পাই’ গানের সঙ্গে একটি সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন। তাঁরা পোপ লিও’র আমেরিকান পরিচয়কে কম গুরুত্ব দেন।

তাঁদের মধ্যে একজন বলেছিলেন, লিও সম্ভবত “আমেরিকানদের মধ্যে সবচেয়ে কম আমেরিকান”। অনেকে মনে করেন, পোপ লিও ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে “সেতুবন্ধন” তৈরি করবেন।

নিউইয়র্কের আর্চবিশপ কার্ডিনাল টিমথি ডোলান বলেন, “আমার মনে হয় না, কার্ডিনালরা পোপ লিওকে ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

ওয়াশিংটনের আর্চবিশপ এমেরিটাস উইলটন গ্রেগরি বলেন, কার্ডিনালদের লক্ষ্য ছিল, এমন একজনকে নির্বাচন করা যিনি “বিশ্বাসের উন্নতি” ঘটাতে পারবেন।

মিলিস আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া একজন পোপকে নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। বরং, ‘আমেরিকানদের মধ্যে সবচেয়ে কম আমেরিকান’ হওয়ার কারণে, তিনি আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতি থেকে মুক্ত এবং নিরাপদ মনে হতে পারেন।”

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *