ট্রাম্পের বিতর্কিত ছাড়: সরকারি আইনে ফাঁকফোকর?

শিরোনাম: ট্রাম্পের ‘ক্ষমতা ছাড়’ : স্বার্থের সংঘাত আইন থেকে কিভাবে রেহাই পান প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য স্বার্থের সংঘাত (conflict of interest) এড়িয়ে চলার কঠোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের জন্য এই নিয়মগুলি কিছুটা শিথিল।

এই বিশেষ ছাড়ের কারণে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, তিনি তার ব্যবসা এবং প্রেসিডেন্ট পদের মধ্যেকার সীমারেখা ঝাপসা করে ফেলছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্রণীত এই আইনে, নির্বাহী বিভাগের প্রত্যেক কর্মীকে আর্থিক স্বার্থের সংঘাত থেকে দূরে থাকতে হয়। এর অন্যথা হলে কারাদণ্ডের মতো শাস্তির বিধানও রয়েছে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট এই আইনের আওতা থেকে কার্যত মুক্ত। এই “রাষ্ট্রপতি বিষয়ক ছাড়” (presidential exemption) নামের বিশেষ সুবিধাটি কয়েক দশক পুরনো, যা ট্রাম্পের সময়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, ট্রাম্প তার ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছেন।

উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্পের শাসনামলে কাতার থেকে ৪00 মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি বিলাসবহুল জেট বিমান গ্রহণ করা হয়েছিল। এছাড়াও, তিনি তার নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সি কয়েনের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ডিনার করেছেন, ট্রাম্প-ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন বিক্রি করেছেন এবং স্কটল্যান্ডের গলফ খেলার মাঠের প্রচার করেছেন।

এমন একাধিক ঘটনায় তার বিরুদ্ধে স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ উঠেছে।

বুশ প্রশাসনের একজন শীর্ষস্থানীয় নীতি বিশেষজ্ঞ, রিচার্ড পেইন্টার এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “আইনের এই ছাড় জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে।

তিনি আরও যোগ করেন, “নাগরিক যুদ্ধের পর থেকে প্রতিটি প্রেসিডেন্টই স্বেচ্ছায় এই সংঘাতগুলো এড়িয়ে গেছেন। তারা এর গুরুত্ব বুঝতেন।

ট্রাম্পের মনোনীত কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। তাদের এই ফৌজদারি আইনের অধীনে কাজ করতে হয়। এক্ষেত্রে, তারা তাদের আর্থিক বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন।

উদাহরণস্বরূপ, সাবেক হেজ ফান্ড ব্যবস্থাপক এবং বর্তমান ট্রেজারি সেক্রেটারি, স্কট বেসেন্ট, তার প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ থেকে ৯৬ শতাংশ বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তবুও, ফেডারেল সরকারের নৈতিকতা বিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা তাকে তার সম্পূর্ণ বিনিয়োগ পরিকল্পনা “সময়মতো” বাস্তবায়ন করতে না পারার জন্য অভিযুক্ত করেছে।

সিএনএন-এর অভ্যন্তরীণ কিছু সরকারি ইমেইল এবং আর্থিক তথ্যে দেখা যায়, পেন্টাগন এবং অফিস অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেট (ওএমবি)-এর আরও কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই বছর নৈতিক বিধি মেনে চলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের বৃহৎ শেয়ার বিক্রি করা, অতীতের নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে জড়িত সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের বিরত রাখা এবং অন্যান্য বিনিয়োগ গুটিয়ে নেওয়া।

তবে, “ওয়াশিংটনের সিটিজেনস ফর রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড এথিক্স” নামক একটি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডোনাল্ড শেরম্যানের মতে, এই আইনটি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির “ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক” পুরোপুরিভাবে রোধ করতে পারে না।

তবে, সরকারি কর্মকর্তাদের স্বার্থের সংঘাত দেখা দিতে পারে এমন প্রকল্প থেকে বিরত থাকাটা অবশ্যই ইতিবাচক।

যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৭০-এর দশকে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পর, ফেডারেল কনফ্লিক্ট ল’ তৈরি করা হয়। নীতি-নির্ধারকরা প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে এই আইনের আওতা থেকে অব্যাহতি দেন, যাতে তারা তাদের অফিসের কাজগুলি আরও ভালোভাবে করতে পারেন।

তবে, সমালোচকদের মতে, ট্রাম্প এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছেন। ওবামার আমলে সরকারের নৈতিকতা বিষয়ক সংস্থার পরিচালক ডন ফক্স বলেন, “বুশ এবং ওবামা এমনভাবে কাজ করেছেন যেন তারা আইনের অধীনে রয়েছেন।

ট্রাম্প এটিকে ফাঁকফোকর হিসেবে দেখেছেন।

জানুয়ারিতে, ট্রাম্প অর্গানাইজেশন একটি নৈতিকতা পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয়েছিল যে ট্রাম্প তার ব্যবসার ব্যবস্থাপনায় “কোনো ধরনের জড়িত” থাকবেন না। কিন্তু এতে কোনো বিনিয়োগ প্রত্যাহার বা কোনো বিষয়ে নিজেকে বিরত রাখার কথা উল্লেখ করা হয়নি।

অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় স্বার্থের সংঘাত এড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট তার বিশাল আর্থিক বিনিয়োগ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।

যদিও এখনো তার কিছু সম্পত্তি রয়েছে, যা বিক্রি করা কঠিন।

ওএমবি-র দুইজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, থমাস উইলিয়ামস এবং গ্রেগ বারব্যাসিয়াও বড় প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। উইলিয়ামস, যিনি ওএমবি-র প্রতিরক্ষা ব্যয়ের সহযোগী পরিচালক, প্যালা access stock-এ তার স্ত্রীর মাধ্যমে ২ মিলিয়ন থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন।

তিনি ছয়টি কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখার কথা জানান। বারব্যাসিয়া, যিনি ফেডারেল সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, এন্ডুরিল ইন্ডাস্ট্রিজে ২৫০,০০০ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছিলেন।

পেন্টাগনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আর্মি আন্ডার সেক্রেটারি পদের জন্য মনোনীত মাইক ওবাদালও এন্ডুরিলের শেয়ার বিক্রি করেছেন এবং তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো থেকে নিজেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করেছেন।

এই ঘটনার মাধ্যমে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি কর্মকর্তাদের স্বার্থের সংঘাত রক্ষার ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ এবং এর সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়। যেখানে একজন প্রেসিডেন্ট আইনের বাইরে থাকতে পারেন, সেখানে তার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য কঠোর নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *