ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি: বিশ্ব বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা
নয়াদিল্লি (কলকাতা): প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের জেরে বিশ্বে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি হয় চরম অনিশ্চয়তা। বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা দেয় অস্থিরতা।
ক্ষমতায় আসার পর, ট্রাম্প মূলত চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি চীনের থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক বসানো শুরু করেন। এর জবাবে চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নেয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করে। এছাড়াও, ট্রাম্প মেক্সিকো এবং কানাডার সঙ্গে উত্তর আমেরিকার বাণিজ্য চুক্তি (ইউএসএমসিএ) পুনর্গঠন করতে চাপ দেন, যার ফলস্বরূপ এই চুক্তি নতুন করে তৈরি হয়।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরও চীন সহ বিভিন্ন দেশের উপর ট্রাম্পের আরোপিত অনেক শুল্ক বহাল রেখেছেন। তবে বাইডেন প্রশাসন বাণিজ্য ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ট্রাম্পের এই ধরনের ব্যাপক শুল্ক আরোপের কারণে বিশ্বজুড়ে ব্যবসা এবং অর্থনীতিতে আরও বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। এর ফলে পণ্যের দাম বাড়তে পারে এবং ভোক্তাদের উপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। গত কয়েক মাসে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের পাল্টা পদক্ষেপের কারণে একটা অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
আসুন, এই বাণিজ্য যুদ্ধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:
- ২০শে জানুয়ারি: ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণের ভাষণে তিনি বিদেশি দেশগুলোর উপর শুল্ক আরোপ এবং কর বাড়িয়ে মার্কিন নাগরিকদের সমৃদ্ধ করার অঙ্গীকার করেন। একই সঙ্গে, তিনি একটি নতুন সংস্থা তৈরির পরিকল্পনার কথাও জানান, যার নাম হবে ‘এক্সটার্নাল রেভিনিউ সার্ভিস’। তবে এই সংস্থাটি এখনো পর্যন্ত গঠিত হয়নি।
- ২৬শে জানুয়ারি: কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো মার্কিন সামরিক বিমানকে তাদের দেশে অভিবাসীদের নিয়ে যেতে দিতে অস্বীকার করলে ট্রাম্প কলম্বিয়ার উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় কলম্বিয়াও মার্কিন পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা করে। তবে পরে কলম্বিয়া তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এবং অভিবাসীদের বহনকারী ফ্লাইটগুলো গ্রহণ করে।
- ১লা ফেব্রুয়ারি: ট্রাম্প মেক্সিকো, কানাডা এবং চীনের থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর শুল্ক আরোপের নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। এর মধ্যে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর ১০ শতাংশ এবং মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপের ফলে তিনটি দেশেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
- ৪ঠা ফেব্রুয়ারি: চীনের সকল পণ্য আমদানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়। চীনও এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করে এবং গুগল-এর বিরুদ্ধে একচেটিয়া বাণিজ্য বিরোধী তদন্ত শুরু করে।
- ১০ই ফেব্রুয়ারি: ট্রাম্প ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা করেন। তিনি ২০১৮ সালে ইস্পাতের উপর আরোপিত শুল্কের ছাড় বাতিল করেন, যার ফলে সব ইস্পাত পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। একই সঙ্গে, অ্যালুমিনিয়ামের উপর ২০১৮ সালের ১০ শতাংশ শুল্ক বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়।
- ১৩ই ফেব্রুয়ারি: ট্রাম্প ‘পারস্পরিক’ শুল্কের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বজুড়ে যে দেশগুলো আমদানি পণ্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক বসায়, তাদের সমান হারে শুল্ক আরোপ করার প্রতিশ্রুতি দেন। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেন যে এই ধরনের পদক্ষেপ বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
- ৪ঠা মার্চ: কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়। তবে কানাডা থেকে আমদানি করা জ্বালানির উপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। চীন থেকে আমদানি করা সকল পণ্যের উপর শুল্কের পরিমাণ দ্বিগুণ করে ২০ শতাংশ করা হয়।
- ৫ই মার্চ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি প্রস্তুতকারকদের জন্য মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়।
- ১০ই মার্চ: চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কৃষি পণ্যের উপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর মধ্যে ছিল মুরগি, শুকরের মাংস, সয়াবিন এবং গরুর মাংস।
- ১২ই মার্চ: ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর নতুন শুল্ক কার্যকর হয়। উভয় ধাতুর উপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এর প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন শিল্প ও কৃষি পণ্যের উপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা করে।
- ১৪ই এপ্রিল: ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে তিনি অটো শিল্পের উপর সাময়িকভাবে শুল্ক ছাড় দিতে পারেন।
- ১২ই মে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাদের মধ্যেকার বাণিজ্য যুদ্ধের অবসান ঘটাতে রাজি হয়। উভয় দেশই একে অপরের উপর আরোপিত শুল্ক কমাতে সম্মত হয় এবং বাণিজ্য যুদ্ধ বন্ধের জন্য ৯০ দিনের একটি চুক্তি করে।
এই শুল্ক নীতিগুলি বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে চীন ও আমেরিকার মধ্যেকার বাণিজ্য সম্পর্ক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস