যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য শুল্কনীতি: ইউরোপে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের সম্ভাবনা, উদ্বেগে আমেরিকা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে একদিকে যখন শুল্ক বৃদ্ধির জেরে আমেরিকায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার আশঙ্কা, তখন ইউরোপে দেখা যেতে পারে ভিন্ন চিত্র। ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপের ফলে ইউরোপে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে পারে।
এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর প্রধান কারণ হতে পারে চীনের সস্তা পণ্যের ইউরোপে প্রবেশ। বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীন সম্ভবত তাদের পণ্যগুলো আমেরিকার বদলে ইউরোপের বাজারে পাঠাতে পারে, যার ফলে সেখানে পণ্যের সরবরাহ বাড়বে এবং দাম কমতে পারে। এছাড়াও, সম্প্রতি ইউরোর দাম বাড়ায় আমদানি আরও সস্তা হবে, যা মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়তা করবে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। শুল্ক বৃদ্ধি আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়াবে, যা সরাসরি আমেরিকান ভোক্তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে। ইতিমধ্যেই কিছু কোম্পানি জানিয়েছে, তারা শুল্কের কারণে হওয়া খরচগুলো গ্রাহকদের ওপর চাপাতে পারে।
যেমন, ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারক ‘আডিডাস’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বলেছেন, শুল্ক বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের দাম বাড়বে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০১৬-২০২০ মেয়াদের ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে নেওয়া শুল্ক নীতির কারণেও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউইয়র্কের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সেই সময়ে আমদানি করা পণ্যের দাম সরাসরি বেড়েছিল। এমনকি, যে কোম্পানিগুলোর ওপর শুল্ক ছিল না, তারাও দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ, তাদের বিদেশি প্রতিযোগীরাও দাম বাড়াচ্ছিল।
তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তেমন কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি। তারা কেবল সীমিত কিছু শুল্ক আরোপের কথা জানিয়েছে। ফলে ইউরোপের বাজারে এর প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম হবে।
নমুরা-র প্রধান ইউরোপীয় অর্থনীতিবিদ জর্জ বাকলি মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেবল একটি দেশের পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতি এই বছর এবং আগামী বছর ইউরোপে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারে, যার চারটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন ল্যাগার্দে-এর মতে, চীন সম্ভবত তাদের রপ্তানি পথ পরিবর্তন করে আমেরিকার বদলে ইউরোপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়লে, স্বাভাবিকভাবেই দাম কমবে।
দ্বিতীয়ত, সস্তা চীনা পণ্যের কারণে ইউরোপে প্রতিযোগিতা বাড়বে, যা পণ্যের দাম কমাতে সহায়তা করবে। তৃতীয়ত, ট্রাম্পের নীতির কারণে ডলারের দুর্বলতার সৃষ্টি হয়েছে।
এর বিপরীতে ইউরোর দাম বেড়েছে, যা আমদানিকে আরও সহজ করে তুলবে। এপ্রিল মাসের শুরুতে প্রায় সব দেশের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ এবং কিছু দেশের পণ্যের ওপর আরও বেশি শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর থেকে ইউরোর দাম বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ।
চতুর্থ কারণ হলো, বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তার ফলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে এবং ভোক্তারা খরচ করতে দ্বিধা বোধ করতে পারে। ফলে, চাহিদা কমলে দামও কমতে পারে।
তবে, ইউরোপে মূল্যস্ফীতি বাড়ার কিছু কারণও রয়েছে। জার্মানির মতো বড় অর্থনীতির দেশ অবকাঠামো এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিশাল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে।
এছাড়াও, ইউরোপীয় নেতারাও প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
যদিও এই সব পরিবর্তনের ফল আসতে কয়েক বছর সময় লাগবে। তবে, বিশ্ব অর্থনীতির এই অস্থির পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে কি হবে, তা বলা কঠিন।
যদিও এই ঘটনাগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে কেন্দ্র করে, তবে এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের জন্য এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
তথ্যসূত্র: সিএনএন