২৫ বছর পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে ট্রাম্পের সাক্ষাৎ: বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য!

সৌদি আরবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারার এক ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ২৫ বছরে এই প্রথম দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সরাসরি সাক্ষাৎ হলো। এই বৈঠক সিরিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে, কেননা দেশটি কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে আছে।

বৈঠকটি হয় সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে, যেখানে ট্রাম্প উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (Gulf Cooperation Council) নেতাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। সিরিয়ার জন্য এটি একটি বড় ঘটনা, কারণ দেশটি এখনো বাশার আল-আসাদের পরিবারের অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময়ের শাসনের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, এই আল-শারার বিরুদ্ধে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ১ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।

বৈঠকের পর এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প আল-শারার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “তিনি একজন তরুণ, আকর্ষণীয় মানুষ। কঠিন মানুষ। তার অতীত খুবই শক্তিশালী, তিনি একজন যোদ্ধা।”

আবু মোহাম্মদ আল-গোলানি ছদ্মনামে পরিচিত আল-শারার একসময় আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তিনি ইরাকে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাতে কয়েক বছর কারাবন্দী ছিলেন।

ট্রাম্প বলেন, “আমার মনে হয়, তিনি সিরিয়াকে একত্র রাখতে পারবেন। তিনি একজন সত্যিকারের নেতা। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তিনি অসাধারণ।”

বৈঠকের আগের দিন ট্রাম্প রিয়াদে তাঁর মধ্যপ্রাচ্য সফরের শুরুতে ঘোষণা করেন যে, তিনি বাশার আল-আসাদের শাসনামলে সিরিয়ার উপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পদক্ষেপ নেবেন। এই ঘোষণায় সিরিয়ার রাস্তায় উল্লাস দেখা যায়। সেখানকার মানুষজন ফায়ারওয়ার্কস ফুটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, কারণ নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল।

অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৈঠকের আগে ট্রাম্পকে সিরিয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা না তোলার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এর মাধ্যমে হোয়াইট হাউস এবং ইসরায়েল সরকারের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান মতবিরোধের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বিশেষ করে গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ চলমান থাকার প্রেক্ষাপটে।

ট্রাম্প উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের সঙ্গে বৈঠকের পর বলেন, “আমি সিরিয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি, যাতে তারা নতুন করে শুরু করতে পারে। এর ফলে তাদের উন্নতির সুযোগ তৈরি হবে। নিষেধাজ্ঞাগুলো সত্যিই খুবই কঠিন ছিল।”

ট্রাম্প আরও জানান, আল-শারা আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দিতে এবং একসময় ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়েছেন, তবে সিরিয়া এখনো পর্যন্ত তা নিশ্চিত করেনি। ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “আমি মনে করি তাদের নিজেদেরকে গুছিয়ে নিতে হবে। আমি তাকে বলেছি, ‘আমি আশা করি আপনারা সবকিছু ঠিকঠাক করার পরে যোগ দেবেন।’ তিনি বলেছেন, ‘হ্যাঁ’। তবে তাদের এখনো অনেক কাজ করতে হবে।”

বৈঠকটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপনীয়। হোয়াইট হাউস পরে জানায়, বৈঠকটি প্রায় ৩০ মিনিটের মতো স্থায়ী ছিল। এর আগে, ২০০০ সালে বিল ক্লিনটনের সঙ্গে হাফেজ আসাদের বৈঠকের পর এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সিরিয়ার কোনো নেতার সাক্ষাৎ হলো।

বৈঠকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও ভিডিও কলের মাধ্যমে ট্রাম্প, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং আল-শারার সঙ্গে যুক্ত হন। তুরস্ক ছিল আল-শারার এবং তাঁর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রধান সমর্থক।

ট্রাম্প বলেন, “আমি মনে করি, এর ফলে তাদের একটি সুযোগ তৈরি হবে। এটা এমনিতেই সহজ হবে না, তবে এর ফলে তাদের ভালো সুযোগ তৈরি হবে। আর, এটা করতে পারাটা আমার জন্য সম্মানের।”

হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট এক বিবৃতিতে জানান, ট্রাম্প আল-শারার প্রতি ইসরায়েলকে কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার, সিরিয়া থেকে সকল বিদেশি সন্ত্রাসীকে চলে যেতে বলার এবং ইসলামিক স্টেট গ্রুপের (আইএস) পুনরুত্থান বন্ধ করতে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

রিপাবলিকান ট্রাম্প আরও অনুরোধ করেন, সিরিয়া সরকার যেন আইএস-এর সন্দেহভাজন প্রায় ৯ হাজার সদস্যকে আটক করে রাখা প্রায় এক ডজনের বেশি ডিটেনশন সেন্টারের দায়িত্ব নেয়। এই কারাগারগুলো পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন বাহিনী, যারা ২০১৯ সালের মার্চে আইএস-এর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়েছিল।

সিরিয়া সরকার এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন বাহিনীর মধ্যে মার্চে হওয়া একটি চুক্তির অংশ হিসেবে, ইরাক ও তুরস্কের সঙ্গে সীমান্ত ক্রসিং, বিমানবন্দর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তেলক্ষেত্রগুলি বছরের শেষ নাগাদ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে।

সিরিয়ার কারাগারগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের আগ্রহ সম্ভবত সিরিয়া থেকে সম্পূর্ণ আমেরিকান সামরিক প্রত্যাহারেরও ইঙ্গিত দেয়।

সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ট্রাম্প এবং আল-শারার মধ্যে সন্ত্রাস এবং স্থিতিশীলতার পথে বাধা সৃষ্টিকারী আইএস-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে সিরিয়া-মার্কিন অংশীদারত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

আল-শারাকে জানুয়ারিতে সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করা হয়। এর এক মাস আগে, আল-শারার নেতৃত্বাধীন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামক বিদ্রোহী গোষ্ঠী দামেস্ক আক্রমণ করে আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটায়।

অনেক উপসাগরীয় আরব নেতা দামেস্কে নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এবং ট্রাম্পকেও একই কাজ করতে বলছেন। তাঁদের ধারণা, এটি ইরানের প্রভাব প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়, যারা এক দশকের গৃহযুদ্ধে আসাদ সরকারকে সমর্থন জুগিয়েছিল।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরায়েল আল-শারার জঙ্গি অতীত সম্পর্কে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছে এবং নতুন সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত মাসে ওয়াশিংটনে নেতানিয়াহুর সফরের সময় এই অনুরোধ করা হয়েছিল।

ইসরায়েলের আশঙ্কা, হামাসের ৭ অক্টোবরের আক্রমণের মতো কোনো সীমান্ত-আক্রমণ সিরিয়া থেকেও হতে পারে। তারা আরও ভয় করে, আল-শারার ইসলামপন্থী অতীত তাদের উত্তর সীমান্তে একটি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ সিরিয়ায় আনন্দের ঢেউ তুলেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা করার পর সিরিয়ার মানুষজন উল্লাস প্রকাশ করে। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সানায় (SANA) দামেস্কের বৃহত্তম উমাইয়া স্কোয়ারে সিরিয়দের উল্লাস এবং ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকে গাড়ির হর্ন বাজাচ্ছিল এবং নতুন সিরিয়ার পতাকা উড়িয়েছিল।

আতশবাজি পুড়িয়ে এবং আনন্দ প্রকাশ করে তারা এই সিদ্ধান্তের উদযাপন করেছে।

সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘোষণাটিকে “সিরীয় জনগণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়” হিসেবে বর্ণনা করে। তারা বলেছে, “এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া সিরিয়ার জনগণের নেতৃত্বে স্থিতিশীলতা, স্বনির্ভরতা এবং জাতীয় পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি করবে।”

তথ্য সূত্র:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *