যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য ঘিরে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেছেন যে উচ্চহারে শুল্ক (ট্যারিফ) আরোপের নীতি সম্ভবত ১৯৩০ দশকের মহামন্দা (Great Depression) প্রতিরোধ করতে পারতো। তবে, ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। ঐতিহাসিক তথ্যের আলোকে, এই মন্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
১৯২৯ সালের মহামন্দা ছিল বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে একটি গভীর সংকট। এর কারণ হিসেবে বিভিন্ন বিষয় উঠে এলেও, বাণিজ্য বিষয়ক কিছু নীতি বিশেষভাবে দায়ী ছিল। তৎকালীন সময়ে, মার্কিন কংগ্রেসম্যান উইলস হ্যালি এবং সিনেটর রিড স্মুটের প্রস্তাবনায় ১৯৩০ সালে ‘স্মুট-হলি ট্যারিফ অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাশ হয়। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিদেশি পণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে মার্কিন কৃষক ও উৎপাদকদের সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু এই পদক্ষেপের ফল হয় ভয়াবহ।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা সত্যি করে, অন্যান্য দেশগুলোও এর প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে শুরু করে, যা বিশ্ব বাণিজ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, স্মুট-হলি আইন ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত, যা অর্থনৈতিক মন্দাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার শাসনামলে বিভিন্ন পণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছিলেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে এই ধরনের শুল্কের মাধ্যমেই গঠিত হয়েছিল। ট্রাম্পের মতে, ১৯১৩ সালে ফেডারেল আয়কর চালু হওয়ার পরে এই নীতির পরিবর্তন হয় এবং ১৯২৯ সালে মহামন্দা দেখা দেয়। ট্রাম্পের দাবি, যদি শুল্কের নীতি বহাল থাকত, তাহলে হয়তো এই সংকট এড়ানো যেত।
তবে, ঐতিহাসিক তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের নীতি ১৯১৩ সালের পরেও অব্যাহত ছিল। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক গ্যারি রিচার্ডসন-এর মতে, একসময় যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তির দিক থেকে অগ্রগামী ছিল বলেই শুল্কের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে ছিল, তখন তারা বিশ্বকে কম শুল্কের নীতি গ্রহণে বাধ্য করেছিল, যা তাদের জন্য সুবিধাজনক ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৭৮৯ সালে জর্জ ওয়াশিংটন ‘ট্যারিফ অ্যাক্ট’ স্বাক্ষর করেন, যা ছিল কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত প্রথম প্রধান আইন। এই আইনের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্যের উপর ৫% শুল্ক ধার্য করা হয়েছিল। এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব সংগ্রহের উৎস ছিল, তেমনি বিদেশি প্রতিযোগিতার হাত থেকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদকদের রক্ষা করতেও সহায়তা করে।
১৮১২ সালের যুদ্ধের পর ব্রিটেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য ব্যাহত হলে, দেশীয় শিল্পকে রক্ষার জন্য আরও শুল্ক আরোপ করা হয়। এরপর ১৮৯০ সালের ‘ট্যারিফ অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে ১,৫০০-এর বেশি পণ্যের উপর শুল্কের হার বেড়ে হয় ৪৯.৫%। এই নীতির প্রবক্তা ছিলেন ‘প্রোটেকশনিজমের নেপোলিয়ন’ খ্যাত উইলিয়াম ম্যাককিনলি, যিনি পরবর্তীতে ১৮৯৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু এই পদক্ষেপের ফলে পণ্যের দাম বাড়ে এবং অর্থনীতির অবনতি ঘটে।
১৯২৯ সালের ‘ব্ল্যাক টিউসডে’-তে শেয়ার বাজারের পতনের মাধ্যমে মহামন্দার সূচনা হয়। এর আগে, ১৯২৮ সালে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোয় অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়। এর ফলস্বরূপ, বাজারে চাহিদা কমে যায়, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় এবং শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার ২৫% পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
ঐতিহাসিক ডেভিড হ্যামিলটনের মতে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভারও শুল্কের পক্ষে ছিলেন, তবে তিনি এটিকে বাণিজ্য যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে দেখেননি। তিনি কৃষকদের জন্য নতুন ধরনের ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন।
স্মুট-হলি ট্যারিফ আইন পাস হওয়ার পর এর ফল ভালো হয়নি। অনেক বাণিজ্য সহযোগী দেশ এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানায়। এর ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা হ্রাস পায়, যা পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরিতেও সহায়ক হয়।
এসব ঐতিহাসিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই মন্তব্য ইতিহাসের সঠিক চিত্র তুলে ধরে না। উচ্চ শুল্ক আরোপের নীতি যে মহামন্দা প্রতিরোধ করতে পারত, এমন দাবির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। বরং, এই ধরনের বাণিজ্য নীতি বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস