যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য শুল্ক: ট্রাম্পের দাবি, ঋণ কমছে, তবে উদ্বেগের কারণও রয়েছে – বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রভাবের সম্ভাবনা।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই তাঁর নেওয়া বাণিজ্য শুল্ক নীতির সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর দাবি, এই শুল্কের কারণে আগামী দশ বছরে ফেডারেল ঋণ প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪১৬ লক্ষ কোটি টাকা) পর্যন্ত কমতে পারে।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সরকারি বিশ্লেষণ থেকে তিনি এই তথ্য তুলে ধরেন। এই হিসাব অনুযায়ী, কয়েক মাস আগের পূর্বাভাসের চেয়েও ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি কমবে।
ট্রাম্প সম্প্রতি একাধিকবার এবং তাঁর নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশালে’ এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, এই শুল্ক নীতি তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ ছিল এবং এর ফল পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, “শুল্ক থেকে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার এসেছে। বাজেট অফিস (সিবিও) এই ঘোষণা করেছে। আমি আগেই বলেছিলাম এমনটা হবে, কিন্তু তারা প্রথমে এর স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। এখন তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, কারণ টাকা আসছে।”
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব কতটা বাড়বে, তা নির্ভর করছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর। যেমন—বর্তমানে আরোপিত শুল্ক ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বহাল থাকে কিনা এবং উচ্চ শুল্কের কারণে দেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ে, তা দেখতে হবে।
কারণ, শুল্কের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে এবং অর্থনীতির দুর্বল হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এমনটা হলে ফেডারেল রাজস্ব কমে যেতে পারে। উল্লেখ্য, সিবিও’র বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি।
ট্রাম্প সম্প্রতি কিছু পরিবর্তন এনেছেন, যা এই বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে, ৮০০ ডলারের কম মূল্যের পণ্য শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশের সুবিধা বাতিল করার সিদ্ধান্ত।
অন্যদিকে, একটি ফেডারেল আপিল আদালত বিবেচনা করছে যে, ট্রাম্প অনেক শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে তাঁর আইনি ক্ষমতা অতিক্রম করেছেন কিনা। এর ফলে কিছু শুল্ক বাতিলও হতে পারে।
এছাড়াও, ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ নীতি বিষয়ক পরিকল্পনা ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ গত মাসে আইনে পরিণত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে ২০২৫ থেকে ২০৩৪ সালের মধ্যে ফেডারেল ঋণ প্রায় ৪.১ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪২৭ লক্ষ কোটি টাকা) পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা শুল্ক থেকে পাওয়া সম্ভাব্য আয়ের চেয়ে বেশি।
ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন দেশ ও পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চীনের বেশিরভাগ পণ্যের ওপর শুল্ক ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি, গাড়ি ও যন্ত্রাংশের ওপর ২৫ শতাংশ পর্যন্ত এবং ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের মতো কিছু পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এই শুল্কের কারণে কম্পিউটার, ইলেক্ট্রনিকস, পোশাক, খেলনা, আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে পারে। যদিও ট্রাম্প দাবি করেন, এর খরচ বিদেশি সরকারগুলো বহন করবে।
সিবিও’র সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এই শুল্ক নীতির কারণে ২০২৫ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে ফেডারেল ঘাটতি ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩৪৫ লক্ষ কোটি টাকা) কমতে পারে। এছাড়া, সুদ বাবদ অতিরিক্ত প্রায় ৭০০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৭৩ লক্ষ কোটি টাকা) সাশ্রয় হতে পারে।
সবমিলিয়ে এর আর্থিক প্রভাব হবে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। সিবিও গত ১৯ আগস্ট পর্যন্ত আরোপিত শুল্কের হিসাব নিয়েছে।
সিবিও’র জুন মাসের প্রথম দিকের এক হিসাবে দেখা যায়, ১৩ মে পর্যন্ত আরোপিত শুল্কের কারণে ফেডারেল ঋণ প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩১৩ লক্ষ কোটি টাকা) কমতে পারে।
তবে, ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও খাতের শুল্কের হারে পরিবর্তন এনেছেন। যেমন—এপ্রিল মাসে চীনের অধিকাংশ পণ্যের ওপর সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এর কয়েক দিনের মধ্যেই চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করলে, ট্রাম্পও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে শুল্কের হার ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন।
মে মাসে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনার পর উভয় দেশই শুল্ক কমাতে রাজি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র সর্বনিম্ন ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে সম্মত হয়। নভেম্বরের মধ্যে এই হার বহাল থাকার কথা রয়েছে।
যদিও ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রে বিরল মৃত্তিকা খনিজ (rare-earth minerals) সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তিনি চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারেন।
ট্রাম্প এও বলেছেন, শুল্ক থেকে পাওয়া কিছু রাজস্ব তিনি আমেরিকানদের মধ্যে রিবেট চেক হিসেবে বিতরণ করার কথা বিবেচনা করতে পারেন। যদিও ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট গত সপ্তাহে সিএনবিসিকে জানান, এই অর্থ জাতীয় ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর (২২ আগস্ট পর্যন্ত) শুল্ক ও অন্যান্য শুল্ক থেকে প্রায় ১৫৬ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৬ লক্ষ কোটি টাকা) রাজস্ব এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘কমিটি ফর এ রেসপনসিবল ফেডারেল বাজেট’-এর সিনিয়র পলিসি ডিরেক্টর মার্ক গোল্ডওয়াইন বলেন, এই রাজস্ব প্রত্যাশার চেয়ে বেশি।
তবে এর প্রভাব কেমন হবে, তা অর্থনীতির ওপর নির্ভর করবে।
গোল্ডওয়াইন আরও বলেন, “যদি আমরা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি এবং মন্দা দেখি, তাহলে এই শুল্ক হয়তো প্রত্যাহার করা হবে, হয়তো পুরোটাই, অথবা বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে কিছু অংশ। অন্যদিকে, যদি সামান্য মূল্যবৃদ্ধি এবং অর্থনীতির দুর্বলতা দেখা যায়, তাহলে হয়তো আমরা এই শুল্কের সঙ্গেই অভ্যস্ত হয়ে যাব।”
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর প্রতিবেদন অবলম্বনে।
(ডলারের হিসাব বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তর করতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১০৪.৫ টাকা ধরা হয়েছে, যা ৩১ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখের বিনিময় হার।)