যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতি: ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের খেলা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য ছিল বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জন করা।
এর মধ্যে ছিল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনখাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও সুসংহত করা। ট্রাম্প প্রায়ই শুল্ককে একটি সর্বরোগহর ঔষধ হিসেবে দেখিয়েছেন—যা একইসঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির চাকরি পুনরুদ্ধার করতে, যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ পরিশোধ করতে, এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নমনীয় করতে সহায়ক হবে বলে মনে করতেন।
শুল্ক আরোপের ফলে তাৎক্ষণিক কিছু প্রভাব দেখা গেলেও, বিশেষজ্ঞরা এর দীর্ঘমেয়াদী ফল নিয়ে সন্দিহান। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাতে বড় ধরনের উল্লম্ফন নাও হতে পারে।
কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, শুল্ক থেকে আসা রাজস্ব দেশটির বিশাল বাজেট ঘাটতির তুলনায় খুবই সামান্য। তাছাড়া, শুল্কের কারণে বিদেশি বাজারগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে, এমন সম্ভাবনাও কম।
ট্রাম্পের নীতির মূল ভিত্তি ছিল—যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য তৈরি করলে শুল্ক দিতে হবে না। এর মাধ্যমে তিনি দেশীয় উৎপাদনে উৎসাহ দিতে চেয়েছিলেন।
উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপল ঘোষণা করেছে তারা যুক্তরাষ্ট্রে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। জেনারেল ইলেক্ট্রিক (GE) তাদের একটি কারখানা চীন থেকে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে, যেখানে তারা ওয়াশিং মেশিন তৈরি করবে।
জেনারেল মোটরসও (General Motors) যুক্তরাষ্ট্রে তাদের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা বলেছে। তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্তগুলোর অনেকগুলোই ট্রাম্পের শুল্ক নীতির আগে বা স্বতন্ত্রভাবে নেওয়া হয়েছিল।
শুল্ক আরোপের ফলে কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে। তবে, বাণিজ্য ঘাটতি কমার অর্থ এই নয় যে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে।
অনেক সময়, বাণিজ্য ঘাটতি একটি শক্তিশালী অর্থনীতির লক্ষণ হতে পারে।
ট্রাম্প প্রায়ই অন্যান্য দেশগুলোর ওপর শুল্কের হুমকি দিয়ে তাঁদেরকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, কানাডা তাদের ডিজিটাল পরিষেবা কর (digital services tax) প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন কোম্পানিগুলোর উপর আরোপ করা হয়েছিল।
কিন্তু সব ক্ষেত্রে এই কৌশল সফল হয়নি। শুল্ক আরোপ করেও যুক্তরাষ্ট্রে ফেনটানির প্রবেশ বন্ধ করা যায়নি।
অ্যাপলকে আইফোন তৈরির কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপন করতে বা হলিউডকে আরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণে রাজি করানো যায়নি।
ট্রাম্পের এই শুল্ক নীতির মূল দুর্বলতা হলো, তাঁর লক্ষ্যগুলো অনেক সময় পরস্পরবিরোধী। যদি শুল্কের মূল উদ্দেশ্য হয় বিদেশি কোম্পানিগুলোকে চাপে রাখা, তাহলে সেই চাপ কমে গেলে শুল্কও তুলে নিতে হবে।
আবার, যদি শুল্কের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো হয়, তাহলে দেশীয় উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্ক একটি জটিল বিষয়। এর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে।
তবে, একইসঙ্গে সব লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন।
বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব:
যুক্তরাষ্ট্রের এই বাণিজ্য নীতি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর ফলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে পারে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র অন্য কোনো দেশের ওপর শুল্ক বাড়ায়, তবে সেই দেশের পরিবর্তে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
আবার, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা কমে গেলে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদেরকেও এই পরিবর্তনগুলো বিবেচনা করে তাঁদের ব্যবসার কৌশল তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন