চীনের চোখে ট্রাম্পের নমনীয়তা: ফুঁসলানো নাকি কৌশল?

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ কি অবশেষে শান্ত হবে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের উপর থেকে শুল্ক কমানোর ইঙ্গিত দিলেও, বেইজিং এটিকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না। বরং তারা চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র যেন তাদের সকল শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়।

এমন পরিস্থিতিতে, এই দুই পরাশক্তির মধ্যেকার বাণিজ্য যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

সম্প্রতি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে, চীনের থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর আরোপিত অতিরিক্ত শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হবে। তিনি আলোচনার টেবিলে ‘নরম’ হওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন এবং কোভিড-১৯ মহামারীর উৎস নিয়ে কোনো কথা বলবেন না বলেও জানান।

কিন্তু চীনের পক্ষ থেকে এর প্রতিক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। তারা চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র যেন তাদের সকল শুল্ক তুলে নেয়, যা বাণিজ্য যুদ্ধের মূল কারণ।

চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হে ইয়াদং এক বিবৃতিতে বলেন, ‘যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে শুল্ক বৃদ্ধি করেছিল, তাই তারাই এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসুক।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অংশীদারদের কথা শোনা উচিত এবং চীনের বিরুদ্ধে নেওয়া সকল শুল্ক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে হবে।’

অন্যদিকে, চীনের কর্মকর্তারা সরাসরি আলোচনার বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন।

ট্রাম্প অবশ্য দাবি করেছেন যে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে ‘প্রতিদিন’ আলোচনা হচ্ছে। তবে, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কুও জিয়াকুন এই ধরনের আলোচনার খবরকে ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

চীনের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্পের এই নরম মনোভাব অভ্যন্তরীণ চাপ এবং বাজারের অস্থিরতা কমানোর একটি কৌশল। তাদের ধারণা, বেইজিং এখন সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে এবং ট্রাম্পের সঙ্গে দ্রুত কোনো চুক্তিতে আসার কোনো তাড়া নেই।

বেইজিং-এর রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিচালক ওয়াং ইওয়েইয়ের মতে, ‘ট্রাম্পের বর্তমান বার্তা অভ্যন্তরীণ উদ্বেগ প্রশমনের চেষ্টা। তিনি হয়তো কিছুটা অস্থির হয়ে পড়েছেন। কিন্তু চীন তার শুল্ক কমানোর কথায় বিশ্বাস করে না। কারণ, তিনি আজ এক কথা বলেন, কাল আবার অন্য কথা বলেন। তাই তাকে বিশ্বাস করা যায় না।’

সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক উ সিনবো মনে করেন, চীন এখন কোনো তাড়াহুড়ো করতে রাজি নয় এবং অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে প্রস্তুত।

‘আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করার পরিবর্তে, কিছুটা সময় অপেক্ষা করা চীনের জন্য আরও উপকারী হতে পারে। এতে আলোচনা আরও মসৃণ হবে এবং চীনের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে,’ তিনি যোগ করেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের অর্থনীতি এখন আগের মতো শক্তিশালী নয়, তাই শেষ পর্যন্ত তাদের আলোচনা করতে হতে পারে। ট্রাম্পের এই সুর পরিবর্তনের কারণ হিসেবে জানা যায়, তিনি সম্প্রতি চারটি বড় মার্কিন খুচরা কোম্পানির প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যেখানে শুল্ক নীতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক প্রভাব এবং বাজারের অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

অনেক বিনিয়োগ ব্যাংক আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, এই বিশাল শুল্ক এবং চীনের প্রতিশোধমূলক শুল্কের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্ক হ্রাসের পরিমাণ নির্দিষ্ট করেননি, তবে হোয়াইট হাউসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চীনের উপর বর্তমানে থাকা ১৪৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ করা হতে পারে।

তবে, ওয়াং ইওয়েইয়ের মতে, এই পরিমাণ শুল্ক কমালেও চীন আলোচনা করতে রাজি হবে না। ‘যদি সত্যিই চীনের সঙ্গে আলোচনা করতে চান, তাহলে প্রথমে এই ভিত্তিহীন শুল্কগুলো বাতিল করতে হবে, এরপর আলোচনার টেবিলে বসতে হবে,’ তিনি বলেন।

চীনের সামাজিক মাধ্যমেও ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়েছে। ‘ট্রাম্প কাপুরুষ’ হ্যাশট্যাগটি দ্রুত জনপ্রিয় হয় এবং এক কোটি পঞ্চাশ লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে।

ব্যবহারকারীরা বলছেন, ‘আমরা এসবের পরোয়া করি না!’

তবে, চীনের অভ্যন্তরে এমন কিছু বিশেষজ্ঞ আছেন, যারা ওয়াশিংটনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী এই দ্বন্দ্বে উদ্বে প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিদেশি নীতি বিশেষজ্ঞের মতে, এই শুল্ক চীনের দুর্বল অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘যদি ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বহাল থাকে, তাহলে আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের ক্ষতি হবে, ব্যাপক হারে চাকরি হারাবে মানুষ, এবং এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে।’

চীনের অভ্যন্তরীণ এই ভিন্নমত প্রায়ই সেন্সর করা হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদিও চীন এই মুহূর্তে শক্ত অবস্থান দেখাচ্ছে, কিন্তু তারা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছে, যেন আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমঝোতাকে নিজেদের জয় হিসেবে তুলে ধরা যায়।

এই বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়তে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার এই টানাপোড়েন বিশ্ব বাণিজ্যকে প্রভাবিত করবে, যা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি এবং সামগ্রিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি ও সুযোগগুলো চিহ্নিত করা জরুরি।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *