যুদ্ধ বন্ধ করতে ট্রাম্পের চাঞ্চল্যকর প্রস্তাব, ইউক্রেন কি ছাড় দেবে?

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন প্রস্তাব, কতটা বাস্তব?

রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধ অবসানে ইউক্রেনকে ভূখণ্ড ছাড়তে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সিএনএন সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ট্রাম্পের পরিকল্পনা হলো, শান্তি চুক্তির বিনিময়ে ইউক্রেন যেন রাশিয়ার কাছে তাদের অধিকৃত এলাকা, বিশেষ করে ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়াকে ছেড়ে দেয়।

তবে ট্রাম্পের এই প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

রাশিয়ার সেনারা বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রাম্পের প্রস্তাব কার্যকর হলে, ইউক্রেনকে এর একটি বড় অংশ ছাড়তে হতে পারে। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্র ক্রিমিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ক্রিমিয়ার এই দখলদারিত্বকে বৈধতা দেওয়া যায় না।

ট্রাম্পের ধারণা, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে কেবল যুদ্ধ বন্ধ করতে বললেই তিনি রাজি হবেন। এর বিনিময়ে পুতিন যদি ইউক্রেনের এতগুলো ভূখণ্ড ধরে রাখতে পারেন, তাহলে তিনি লাভবান হবেন। যদিও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, তিনি কোনো ভূখণ্ড ছাড়তে রাজি নন।

এমনকি, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে দেয়, সেক্ষেত্রেও কিয়েভ সরকার তাদের অবস্থানে অনড় থাকবে।

বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিভ উইটকফ সম্প্রতি মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। অন্যদিকে, ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিরা লন্ডনসহ বিভিন্ন স্থানে মার্কিন ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তাদের প্রস্তাব হলো, কোনো ভূখণ্ড ছাড়ার আলোচনার আগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হোক। আগামী দিনে পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে ট্রাম্প ও জেলেনস্কি উভয়ই উপস্থিত থাকবেন। সম্ভবত সেখানেই শান্তি আলোচনা নিয়ে কোনো অগ্রগতি হতে পারে।

তবে, পরিস্থিতি এখনো বেশ জটিল। একদিকে যেমন যুদ্ধ চলছে, তেমনি রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে, ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুতিনকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

ক্রিমিয়া নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান :

এপ্রিল মাসের শেষের দিকে টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, “ক্রিমিয়া রাশিয়ার সঙ্গেই থাকবে।” তিনি আরও বলেন, “জেলেনস্কি এটা বোঝেন এবং সবাই জানেন যে এটি অনেক দিন ধরেই তাদের (রাশিয়ার) সঙ্গে আছে।

২০১৪ সালে রাশিয়া প্রথম ক্রিমিয়া দখল করে। এরপর আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার ঝড় উঠলেও, তখন তেমন কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে, ২০২২ সালে ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণের পর পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নেয়।

ট্রাম্পের প্রস্তাব, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি যুদ্ধবিরতির সূচনা করতে চাইছে।

ইউক্রেনের প্রতিক্রিয়া :

জেলেনস্কি প্রকাশ্যে ক্রিমিয়া ছাড়তে রাজি নন। কারণ, এটি ইউক্রেনের সংবিধানের পরিপন্থী।

তবে, কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিৎস্কো বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শান্তির জন্য ক্রিমিয়া ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন হতে পারে।

যদি ক্রিমিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কি শান্তি আসবে?

ওয়াশিংটন পোস্টের একজন কলামিস্ট ডেভিড ইগনাতিয়াস মনে করেন, ক্রিমিয়া ইস্যুটির সমাধান হলে, ইউরোপীয় সেনাদের মাধ্যমে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে। এছাড়াও, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুরক্ষিত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিও থাকতে পারে।

তবে, সিএনএনের সাংবাদিক নিক প্যাটন ওয়ালশ মনে করেন, ট্রাম্প আসলে পুতিনের কাছ থেকে ঠিক কী চান, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, পুতিন মনে করেন, সময় তাঁর পক্ষেই।

যুক্তরাষ্ট্র যদি ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে কি সমস্যা হবে?

যদি যুক্তরাষ্ট্র ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তবে এটি হবে একটি গুরুতর ভুল। কারণ, এর মাধ্যমে ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডামের লঙ্ঘন হবে।

এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্তকে সম্মান জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। এর বিনিময়ে ইউক্রেন তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করে।

যদি যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন তুলে নেয়, তাহলে কী হবে?

যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে সহায়তা করা বন্ধ করে দেয়, সেক্ষেত্রে কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো আন্দ্রেয়া ক্যান্ডাল-টেলরের মতে, এর অর্থ হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো কূটনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেবে, অথবা সামরিক সহায়তাও বন্ধ করে দেবে।

যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন বন্ধ করলেও কি ইউক্রেন লড়বে?

ইউক্রেন তাদের প্রতিরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং গোয়েন্দা তথ্যের জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নেয়। তবে, ইউক্রেন নিজস্ব সম্পদ তৈরি করেছে এবং ইউরোপের ওপরও নির্ভর করছে।

ক্যান্ডাল-টেলরের মতে, যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য বন্ধ করলেও ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। বর্তমানে ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রাশিয়ার সৈন্যদের বেশি ক্ষতি হচ্ছে।

পুতিনের কি যুদ্ধ বন্ধ করার কোনো আগ্রহ আছে?

ক্যান্ডাল-টেলরের মতে, তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। পুতিন সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাইছেন। তাঁর মূল লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে ইউক্রেনকে একঘরে করা।

ইউরোপ কি যুক্তরাষ্ট্রের শূন্যস্থান পূরণ করবে?

রাশিয়ার ও ইউক্রেন বিষয়ে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিশেষজ্ঞ মাইকেল কিমমেজ বলেন, সম্ভবত মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য আর বেশি অর্থ দেবে না।

এক্ষেত্রে জার্মানি এগিয়ে আসতে পারে। জার্মানির প্রতিরক্ষা খাতে আগামী কয়েক বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে, যার একটি অংশ ইউক্রেনকে সহায়তা করতে পারে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *