ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন: আলোচনার শুরু থেকে অচলাবস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকার করেছিলেন। ক্ষমতায় আসার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি এই যুদ্ধ থামাবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় দু’মাস পরেও সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি, বরং আলোচনার টেবিলে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্পের এই প্রতিশ্রুতি রক্ষার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে, প্রথমে তিনি সময়সীমা বাড়িয়ে ছয় মাস করেন, পরে আবার জানান, তিনি সম্ভবত “একটু রসিকতা” করেছিলেন। সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে মস্কো হয়তো “ধীরে চলো” নীতি অবলম্বন করছে।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ট্রাম্প ইউক্রেনকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হলে কিয়েভকে তার কঠোর অবস্থান মেনে নিতে হবে।
রাশিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে জানালেও, তারা বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়ায় চুক্তিগুলো ভেস্তে যাচ্ছে।
আলোচনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি কেমন ছিল, তার একটা চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো:
২০শে জানুয়ারি: ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
১২ই ফেব্রুয়ারি: ট্রাম্প জানান, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রথম তাদের মধ্যে ফোনালাপ হয়। এই পদক্ষেপ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এবং এতে ইউরোপীয় মিত্ররা কিছুটা বিস্মিত হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে এবং ২০২২ সালে তারা পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ শুরু করে।
একই দিনে ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে পুতিনের সঙ্গে তার আলোচনার বিষয়ে অবহিত করেন এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের পরিকল্পনার কথা জানান।
১৫ই ফেব্রুয়ারি: হোয়াইট হাউস জানায়, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে আলোচনা শুরুর জন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা সৌদি আরবে রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হবেন।
১৭ই ফেব্রুয়ারি: কিয়েভ এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররা এই আলোচনা থেকে তাদের বাদ রাখায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে।
তারা জোর দিয়ে বলে যে, ইউক্রেনকে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত না করে কোনো চুক্তি হতে পারে না।
এরপর প্যারিসে ইউরোপীয় ও ন্যাটোর নেতাদের একটি জরুরি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
১৮ই ফেব্রুয়ারি: সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারকো রুবিও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এই বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ এবং ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফও উপস্থিত ছিলেন।
রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের প্রধান কিরিল দিমিত্রিভ।
আলোচনার পর রুবিও বলেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে উভয় পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে।
একই সময়ে ট্রাম্প জেলেনস্কির সমালোচনা করেন, যিনি ইউক্রেনের অনুপস্থিতিতে হওয়া কোনো চুক্তি মানতে রাজি নন বলে জানিয়েছিলেন।
২৮শে ফেব্রুয়ারি: জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, যেখানে তার একটি খনিজ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল।
তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স জেলেনস্কির সমালোচনা করে এবং যুদ্ধ বন্ধের জন্য কূটনীতির আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিলে দুই নেতার মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়।
১লা মার্চ: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠকটি ভালো ফল না দেওয়ায় ইউরোপীয় নেতারা উদ্বিগ্ন হন এবং ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে লন্ডনে একটি জরুরি শীর্ষ বৈঠক করেন।
২রা মার্চ: ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর যুক্তরাজ্যে জেলেনস্কিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং রাজা তৃতীয় চার্লস তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
৩রা মার্চ: ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেবেন।
কর্মকর্তারা জানান, এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেনি এমন সব সহায়তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
ইউরোপ ও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা সহায়তা বন্ধের প্রভাব মূল্যায়ন এবং ইউক্রেনকে কীভাবে সশস্ত্র রাখা যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা করতে শুরু করেন।
৪ঠা মার্চ: জেলেনস্কি এক বিবৃতিতে জানান, ওভাল অফিসের বৈঠকটি পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি, তবে ইউক্রেন খনিজ চুক্তি স্বাক্ষরে প্রস্তুত।
তিনি ক্ষমা চাননি।
৫ই মার্চ: যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা ইউক্রেনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ করে দেবে।
পরে ইউক্রেনীয় ও মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, তারা “নিকট ভবিষ্যতে” মিলিত হতে রাজি হয়েছেন।
১১ই মার্চ: সৌদি আরবে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার পর ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে নীতিগতভাবে রাজি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ও গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান পুনর্বহাল করতে সম্মত হয়।
১৩ই মার্চ: উইটকফ ক্রেমলিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে মস্কো যান এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন।
পুতিন নীতিগতভাবে রাজি হলেও, তিনি এমন কিছু শর্ত দেন যা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন করে তোলে।
তার শর্তগুলোর মধ্যে ছিল, ইউক্রেন যেন সেনা সমাবেশ ও সৈন্যদের প্রশিক্ষণ বন্ধ করে এবং যুদ্ধবিরতির সময় অন্য দেশগুলো যেন কিয়েভকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে।
১৮ই মার্চ: ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন, কিন্তু তাকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি করাতে ব্যর্থ হন।
হোয়াইট হাউস জানায়, রাশিয়া ইউক্রেনের জ্বালানি ও অবকাঠামোতে হামলা সাময়িকভাবে বন্ধ করতে রাজি হয়েছে।
কিন্তু রাশিয়া জানায়, তারা শুধুমাত্র “জ্বালানি অবকাঠামোতে” হামলা করা থেকে বিরত থাকবে।
১৯শে মার্চ: ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে ফোনালাপ হয়।
ট্রাম্প জানান, আলোচনাটি “খুব ভালো” হয়েছে এবং প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে।
আলোচনার মূল বিষয় ছিল আগের দিন পুতিনের সঙ্গে তার কথোপকথন।
২১শে মার্চ: ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর নগরী ওডেসায় রাশিয়ার বড় ধরনের ড্রোন হামলা হয়।
২৩শে মার্চ: সৌদি আরবে মার্কিন ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ এই আলোচনাকে “ফলপ্রসূ ও সুসংহত” হিসেবে বর্ণনা করেন।
২৪শে মার্চ: সৌদি আরবে মার্কিন কর্মকর্তারা রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
২৫শে মার্চ: সৌদি আরবের রিয়াদে একই হোটেলে রুশ ও মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়।
বিকেলে হোয়াইট হাউস জানায়, ইউক্রেন ও রাশিয়া “নিরাপদ নৌ চলাচল নিশ্চিত করতে, শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করতে এবং বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে” রাজি হয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, কিয়েভ কৃষ্ণ সাগরে সামরিক শক্তি ব্যবহার বন্ধ করতে রাজি হয়েছে, তবে এর কিছুক্ষণ পরেই ক্রেমলিন জানায়, তারা এই চুক্তিতে রাজি হবে, যদি রাশিয়ার প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
ফলে চুক্তিটি কার্যত ভেস্তে যায়।
এরপর ট্রাম্প নিউজম্যাক্সকে বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে চায়, তবে সম্ভবত তারা চুক্তি বিলম্বিত করছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন