যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েও কেন তা সম্ভব হচ্ছে না? ট্রাম্পের নীতি বিশ্লেষণ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি একদা ক্ষমতায় আসার পর ইউক্রেন এবং গাজায় যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকার করেছিলেন, তার সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন এখনো অধরা।
বরং, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন এমনটা হচ্ছে? আসুন, সেই কারণগুলো বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম সিএনএনের বিশ্লেষণে জানা যায়, ট্রাম্পের এই ব্যর্থতার মূল কারণ সম্ভবত দুটি অঞ্চলে—ইউক্রেন এবং গাজায়—যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো ‘সম্ভাব্য সমঝোতা ক্ষেত্র’ (Zone of Possible Agreement বা ZOPA) তৈরি না হওয়া।
সহজ ভাষায় বললে, উভয় পক্ষের মধ্যে এমন কোনো অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, যেখানে তারা যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হবে।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে দ্রুত ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) পরাজিত করবেন।
যদিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি মূলত বারাক ওবামার নীতি অনুসরণ করেন এবং তাঁর প্রথম মেয়াদের তৃতীয় বছরে আইএসকে পরাজিত করা হয়।
এরপর, তিনি ইউক্রেন এবং গাজায় দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি তার উল্টো।
গাজায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের জন্য তাদের প্রধান শর্ত হিসেবে চাইছে গাজার শাসন ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকুক।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি যুদ্ধবিরতি এবং পুনর্গঠন পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা এই ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। অন্যদিকে, ইসরায়েল কোনো অবস্থাতেই হামাসকে গাজার ক্ষমতায় দেখতে রাজি নয়।
তাদের লক্ষ্য হলো, যুদ্ধ শেষে হামাস যেন গাজা শাসন করতে না পারে। ফলে, কোনো সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া শুরু থেকেই ইউক্রেনকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছে।
তারা ইউক্রেনের কিছু অংশ নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় এবং দেশটির সামরিক শক্তিকে দুর্বল করতে চায়। কিন্তু ইউক্রেন রাশিয়ার এই দাবি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
তারা চায় রাশিয়ার সেনা তাদের দেশ থেকে চলে যাক এবং পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এখানেও, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি।
বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে, ট্রাম্পের নীতি ছিল বেশ দ্বিধাগ্রস্ত। কখনো তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে শান্তির পথে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, আবার কখনো রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার কথা বলেছেন।
এমনকি, তিনি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফলস্বরূপ, প্রেসিডেন্ট ও তাঁর কর্মকর্তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা সত্ত্বেও কোনো অগ্রগতি হয়নি, বরং রাশিয়ার আগ্রাসন আরও বেড়েছে।
গাজায় যখন মানবিক সংকট তীব্র, তখন ট্রাম্প গাজায় মানবিক সহায়তা বিষয়ক সমন্বয়কের পদ বিলুপ্ত করেন এবং গাজায় মার্কিন সহায়তা তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID)-কে বাতিল করেন।
এমনকি, ইসরায়েল যখন গাজায় দীর্ঘ সময় ধরে অবরোধ জারি রেখেছিল, তখনও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। এরপর, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করারও আহ্বান জানান তিনি।
অন্যদিকে, ইউক্রেনকে সহায়তা করার ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের নীতি ছিল দুর্বল।
তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে নিষেধাজ্ঞার সুবিধা দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং ইউক্রেনকে পর্যাপ্ত সহায়তা দিতেও গড়িমসি করেছেন।
তবে, সম্প্রতি ট্রাম্প তাঁর নীতিতে কিছু পরিবর্তন এনেছেন।
তিনি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এমনকি, রাশিয়ার জ্বালানি পণ্য ক্রয় করা দেশগুলোর বিরুদ্ধেও শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গাজায় মানবিক সংকট মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
একইসঙ্গে, ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে, দেশটির সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে ন্যাটো মিত্রদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে এবং রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
যুদ্ধ বন্ধ করা সবসময় কঠিন কাজ।
ট্রাম্পের নেওয়া পদক্ষেপগুলো যদি সুসংহত ও সুচিন্তিত হতো, তাহলে হয়তো ফল অন্যরকম হতে পারত।
বর্তমানে, গাজায় মানবিক সংকট নিরসনে এবং ইউক্রেনকে সমর্থন জোগানোর ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নতুন নীতি কতটুকু সফল হয়, এখন সেটাই দেখার বিষয়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন।