আচমকা একটি বিশাল ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বাড়িঘর, কেড়ে নিয়েছিল স্বজনদের। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত রবিনসন ক্রুসো দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবনে নেমে এসেছিল এক বিভীষিকা।
ঘটনাটি ছিল ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের, যখন এক ভয়াবহ সুনামিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দ্বীপটি। সেই ধ্বংসলীলার সাক্ষী ছিলেন পেদ্রো ” পিটার” নিয়াডা এবং তাঁর পরিবার।
ভোর ৪:৩০ মিনিটে ঘুম ভেঙেছিল পিটার নিয়াডার। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন হয়তো কোনো উল্কাপাত হয়েছে, যার কারণে তাঁর বাড়িটি কেঁপে উঠেছে।
কিন্তু যখন তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেন, পায়ের পাতায় জলের স্পর্শ পান। তখনই বুঝতে পারেন, বাড়িটি ডুবে যাচ্ছে। তাঁর চারপাশের সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। বাইরে তখন যেন এক জলপ্রপাতের শব্দ।
“সুনামি!” চিৎকার করে উঠলেন পিটার। তাঁর স্ত্রী ফ্যাবিয়ানা পার্সিয়া ও ছেলে-মেয়ে তখন গভীর ঘুমে। প্রথমে তারা বিষয়টি বিশ্বাস করতে চাননি।
কিন্তু যখন তাঁদের ঘরটিও পানির তোড়ে দিকভ্রান্ত হতে শুরু করলো, তখন তাঁরা সবাই জীবন বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন।
দ্বীপের অন্য বাসিন্দাদের মতো, নিয়াডার পরিবারও যেন প্রকৃতির রুদ্ররোষের শিকার হয়েছিল। তাঁদের ঘর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল, আর চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল ধ্বংসস্তূপ।
সৌভাগ্যক্রমে, তাঁদের কাছাকাছি একটি মাছ ধরার নৌকা ছিল। ম্যাথিউ ওয়েস্টকট নামে এক ব্যক্তি, যিনি সেই সময় দ্বীপে বেড়াতে এসেছিলেন, তাঁদেরকে উদ্ধার করেন।
পিটার তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে নৌকাটিতে উঠতে সক্ষম হন।
সুনামির সেই ভয়াবহতা দ্বীপের জীবনযাত্রায় গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। দ্বীপের একমাত্র গ্রামটি যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেখানকার স্কুল, পুলিশ স্টেশন, এমনকি গোরস্থানও সুনামির গ্রাসে বিলীন হয়ে যায়।
নিয়াডা পরিবারের চোখের সামনে তাঁদের প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের ভেসে যেতে দেখেন তাঁরা। এই ঘটনায় দ্বীপের ১৬ জন মানুষ প্রাণ হারান।
সুনামির ভয়াবহতা কাটিয়ে ওঠা সহজ ছিল না পিটার নিয়াডার জন্য। প্রিয়জন হারানোর শোক, সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে ফিরছিল। তিনি মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেন।
একসময় তিনি নিজের বাড়ি তৈরি করা, গাছ কাটা ও কাঠ চেরাইয়ের স্মৃতিচারণ করে হতাশ হয়ে পড়তেন।
এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ ১৫ বছর। ধীরে ধীরে পিটার তাঁর জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
একসময় তিনি আবার ডুবুরি হিসেবে কাজ শুরু করেন। অবশেষে, তিনি আবার ফিরে যান সেই দ্বীপে, যেখানে ঘটেছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন ঘটনা।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে, সেই ভয়ংকর সুনামির ১৫ বছর পূর্তিতে পিটার যখন দ্বীপে ফেরেন, তখনও সেখানকার মানুষ তাঁকে ভোলেনি।
সবাই তাঁকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পিটার যেন নতুন করে অনুভব করেন তাঁর জীবনের গভীর ক্ষতগুলো, যা হয়তো কোনোদিন পুরোপুরি সারবে না।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান