কফির সঙ্গে ভাগ্য! তুরস্কের সংস্কৃতিতে কফির জাদু

কফি—এই একটি নাম শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক কাপ উষ্ণতা, যা ক্লান্তি দূর করে মনকে সতেজ করে তোলে। সারা বিশ্বে কফির কদর থাকলেও, তুরস্কের কফির সংস্কৃতি যেন একটু ভিন্ন।

এটি শুধু পানীয় নয়, বরং একটি ঐতিহ্য, আলোচনা, এবং ৫০০ বছরের পুরনো ইতিহাস। ইউনেস্কো (UNESCO) এটিকে “ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

কফির উৎপত্তির ইতিহাস আরও গভীরে প্রোথিত। জানা যায়, দ্বাদশ শতকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে কফির বীজ পাওয়া গিয়েছিল। এরপর ১৩৫০ সাল নাগাদ তুরস্ক, মিশর ও পারস্যে কফি পরিবেশনের সরঞ্জাম দেখা যায়।

তবে, তুরস্কের কফির গল্প শুরু হয়েছিল ইয়েমেনে। পঞ্চদশ শতকে সুফি সাধকরা দীর্ঘ রাত জেগে প্রার্থনা করার জন্য কফি পান করতেন। ১৫৩৮ সালে সুলতান সুলেমান ইয়েমেন জয় করার পর কফি অটোমান সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে।

এর এক বছরের মধ্যেই কফির বীজ কনস্টান্টিনোপল-এ (বর্তমান ইস্তাম্বুল) পৌঁছে যায়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৩৯ সালে অটোমান নৌ-বহরের প্রধান খায়রেদ্দিন বার্বারোসা একটি ‘কফি রুম’ তৈরি করেন। এর কিছুকাল পরেই, পঞ্চদশ শতকে ইস্তাম্বুলে ‘কফি হাউস’-এর আবির্ভাব হয়।

এই পানীয়ের জনপ্রিয়তা দ্রুত সামাজিক জীবনকে নতুন রূপ দেয়। তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী ‘সেজভে-ইব্রিক’ পদ্ধতিতে কফি তৈরি করা হয়, যা মূলত ইথিওপিয়া থেকে এসেছে।

এটি গ্রীসেও প্রচলিত। গ্যাস্ট্রোনমি গবেষক মেরিন সেভারের মতে, এই পদ্ধতিতে কফি তৈরি করা হয় মূলত “রান্নার” মতো, যেখানে এটি সরাসরি পানির সাথে মিশিয়ে ফিল্টার ছাড়াই পরিবেশন করা হয়।

কফি হাউসগুলি শুরুতে বিতর্কের জন্ম দেয়। এশিয়া ও ইউরোপের ধর্মীয় পণ্ডিত ও রাজনৈতিক নেতারা এগুলোকে আলোচনা ও সমালোচনার জায়গা হিসেবে দেখতেন। ১৫১১ সালে মক্কার গভর্নর খায়ের বে কফি নিষিদ্ধ করেন, যা ১৩ বছর পর্যন্ত বহাল ছিল।

সুলতানও একই কারণে ক্যাফে বন্ধ করে দিতেন। তবে কফি হাউসগুলো একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। এমনকি সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসও এগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, কারণ তিনি মনে করতেন এখানে “রাজতন্ত্র বিরোধী আলোচনা” হয়।

তুর্কি কফিকে “পানীয়ের চেয়েও বেশি কিছু” হিসেবে বর্ণনা করেন সাফ্রানবোলুর বাসিন্দা ও সাউথ ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক সেদেন দোগান। তিনি বলেন, কফি হলো “একটি সেতু”, যা দুঃখ-আনন্দ ভাগ করে নিতে সহায়তা করে।

আজকাল, তুরস্কের বন্ধুদের মধ্যে দেখা হলে কফি খাওয়ার কথা হয়। এর মানে হলো, “এসো, আমি তোমাকে তুর্কি কফি বানিয়ে দিই”।

এই কফি তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ নিপুণ। একটি ছোট, লম্বা হাতলওয়ালা পাত্রে (সেজভে) গরম বালু অথবা কয়লার আগুনে কফি ধীরে ধীরে ফুটিয়ে নেওয়া হয়। কফির সেরা স্বাদ পাওয়ার জন্য এটি করা হয় এবং এর উপরে সুন্দর ফেনা তৈরি হয়, যা কফির গুণাগুণ নির্দেশ করে।

একটি আসল তুর্কি কফি গরম গরম পরিবেশন করা হয়, সাথে এক গ্লাস পানি এবং ‘লোকুম’ (ঐতিহ্যবাহী তুর্কি মিষ্টি) থাকে। পানি তালু পরিষ্কার করে এবং লোকুম কফির তেতো স্বাদকে balance করে।

কফি পানের শিষ্টাচারও গুরুত্বপূর্ণ। ছোট কাপে পরিবেশন করা হলেও, এটি ধীরে ধীরে, শান্তভাবে পান করতে হয়, যেন কফির নিচে থিতু হওয়া গুঁড়ো কাপের তলায় জমা হতে পারে।

কাপ খালি হয়ে গেলে আসে ‘ট্যাসেওগ্রাফি’ বা কফি কাপের ভবিষ্যৎ বলার পালা। কাপটি উপুড় করে একটি প্লেটের উপর রাখা হয়, ঠাণ্ডা হওয়ার পর কাপের তলার কফির জমাট বাঁধা আকার দেখে ভবিষ্যৎ বলার চেষ্টা করা হয়।

সাধারণত এই ভবিষ্যৎবাণী তাৎক্ষণিক ভাবে তৈরি করা হয়। যেমন, মাছ দেখা গেলে সৌভাগ্য এবং পাখি দেখা গেলে ভ্রমণের ইঙ্গিত দেয়।

ইসলামে ভাগ্য গণনাকে নিরুৎসাহিত করা হলেও, কফি কাপের ভবিষ্যৎ বলার এই রীতিকে দেখা হয় “আনন্দদায়ক, প্রতীকী ব্যাখ্যা” হিসেবে। দোগানের মতে, এই কাজটি মূলত গল্প বলার মতো, যেখানে মানুষজন তাদের সম্পর্কে ভালো কথা শুনতে পছন্দ করে।

তুরস্কের কফির এই ঐতিহ্য বিয়ের অনুষ্ঠানেও দেখা যায়। বিয়ের আগে হবু কনে, বর ও তার পরিবারের জন্য তুর্কি কফি তৈরি করেন। বরের চরিত্র যাচাই করার জন্য কফির সাথে প্রচুর লবণ মেশানো হয়।

বর যদি কোনো অভিযোগ ছাড়াই তা পান করে, তবে তার ধৈর্য, পরিপক্কতা ও যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

তবে, তুর্কি কফি এখনো এসপ্রেসোর মতো বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। সেভার এর কারণ হিসেবে প্রজন্মের ব্যবধানকে দায়ী করেন। তিনি মনে করেন, “আমরা তুর্কি কফিকে একটি অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে এটি এখন শুধু বাবা-মায়ের সাথে খাওয়ার একটি বিষয়।”

অন্যদিকে, অনেকে বিশ্বজুড়ে তুর্কি কফির প্রচারের জন্য কাজ করছেন। যেমন, আয়শে কাপুসুজ লন্ডনে তুর্কি কফির কর্মশালা করেন, আর নিউইয়র্কে ‘ডক্টর হানিবিউ’ নামে পরিচিত উলুচ উলজেন কফি পানের আসর ও ভাগ্যগণনার আয়োজন করেন।

ইস্তাম্বুলে একটি ভালো কফি অভিজ্ঞতার জন্য, কাপুসুজ এমন একটি জায়গা খুঁজে বের করার পরামর্শ দেন, যেখানে সেজভেতে ধীরে ধীরে, গরম বালি বা কয়লার আগুনে কফি তৈরি করা হয় এবং গরম গরম পরিবেশন করা হয়, সাথে লোকুম ও পানি থাকে।

ইস্তাম্বুলে হাফিজ মুস্তাফা, ইস্তিকলাল স্ট্রিটের ম্যান্ডাবাতমাজ এবং মিশরীয় বাজারের নুরি টপলার-এর নাম তিনি উল্লেখ করেন। আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে হলে, কাদেকয়ের হাজি বেকির-এ যেতে পারেন।

তথ্যসূত্র: CNN

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *