তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের উত্থান: বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়?
সামরিক শক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটিয়েছে। একসময় যারা অস্ত্র আমদানিকারক ছিল, তারাই এখন বিশ্ব বাজারে শক্তিশালী অস্ত্র রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। তুরস্কের এই অভাবনীয় উত্থান বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সামরিক স্বনির্ভরতার পথে তুরস্ক
১৯৮০-এর দশকে তুরস্ক সামরিক খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেয়। ১৯৮৫ সালে তারা প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন ও সহায়তা বিষয়ক দপ্তর (SAGEB) প্রতিষ্ঠা করে। শুরুতে, SAGEB আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষণা ও উন্নয়নে জোর দেয়।
কিন্তু বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র ক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে তুরস্ক স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদন শুরু করতে বাধ্য হয়। ২০১০-এর দশকে তারা নিজস্ব নকশার ওপর গুরুত্ব দেয়, যা তাদের প্রতিরক্ষা উৎপাদনকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে।
আজ, তুরস্কের হাজার হাজার প্রতিরক্ষা প্রস্তুতকারক স্থল, নৌ ও আকাশ পথের জন্য অত্যাধুনিক সরঞ্জাম তৈরি করছে। তাদের তৈরি করা অস্ত্রশস্ত্র এখন আন্তর্জাতিক মহলেও বেশ পরিচিতি লাভ করেছে।
তুরস্কের প্রধান অস্ত্র ও সরঞ্জাম
তুরস্কের তৈরি করা সবচেয়ে পরিচিত ড্রোন সম্ভবত Bayraktar TB2। ২০১৪ সালে এটি প্রথমবার ব্যবহার করা হয় এবং বর্তমানে এটি বিশ্বের অনেক দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়াও, Anka-S নামের মাঝারি উচ্চতার দীর্ঘ-স্থায়ীত্ব সম্পন্ন ড্রোন এবং Vestel Karayel-এর মতো কৌশলগত ড্রোনও তাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে অন্যতম।
তুরস্ক “ইস্পাত গম্বুজ” (Celik Kubbe) নামে একটি অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যেকোনো আকাশ পথের হুমকি শনাক্ত করতে সক্ষম।
স্থলভাগে, তুরস্কের প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক হলো Altay। এটি জার্মানির Leopard বা আমেরিকার Abrams-এর মতো পশ্চিমা মডেলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা রাখে। এছাড়া, তারা Kirpi (হজহগ) নামের মাইন প্রতিরোধী যান এবং আধুনিক পদাতিক যুদ্ধ যান তৈরি করছে।
নৌবাহিনীর জন্য তুরস্ক তৈরি করছে MILGEM শ্রেণির যুদ্ধজাহাজ। ২০০৪ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং এর অধীনে অত্যাধুনিক Ada শ্রেণির করভেট ও Istanbul শ্রেণির ফ্রিগেট তৈরি করা হয়েছে। তুরস্কের নৌ বহরের সবচেয়ে বড় জাহাজ হলো TCG Anadolu, যা ড্রোন বহন করতে সক্ষম। ২০২৩ সালে এটি নৌবহরে যুক্ত হয়।
ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম
তুরস্ক বিভিন্ন ধরনের স্মার্ট গোলাবারুদ, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Bora স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং Atmaca নামের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র।
রপ্তানির পরিসংখ্যান ও বাজারের বিস্তার
বর্তমানে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের আকার অনেক বড় হয়েছে। তারা এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তুরস্ক অস্ত্র রপ্তানিতে বিশ্বে ১১তম স্থানে ছিল।
গত বছর তুরস্কের অস্ত্র রপ্তানি ১৭৮টি দেশে পৌঁছেছে, যা ২০১৫-২০১৯ সালের তুলনায় ১০৩ শতাংশ বেশি। তুরস্কের প্রধান ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান ও কাতার।
Bayraktar TB2 ড্রোন অন্তত ৩১টি দেশে রপ্তানি হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইরাক, ইউক্রেন, কেনিয়া, বাংলাদেশ ও জাপান। গত বছর, এই ড্রোনের প্রস্তুতকারক সংস্থা Baykar তাদের নিজস্ব জেট ইঞ্জিন তৈরির জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশের জন্য গুরুত্ব
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী আধুনিকায়নের পথে হাঁটছে। তুরস্কের এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। Bayraktar TB2 ড্রোন বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করেছে।
তুরস্ক থেকে উন্নত সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে এবং তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ তার প্রতিরক্ষা শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
উপসংহার
সামরিক খাতে তুরস্কের এই অভাবনীয় উন্নতি বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে তুরস্ক যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তা অনুসরণ করে বাংলাদেশ তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করতে পারে। উন্নত প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে তুরস্কের মতো বাংলাদেশও সামরিক শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা