ঐতিহ্য আর আতিথেয়তার এক দারুণ মিশেল: তুরস্কের কফির গল্প। চা-এর দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে কফির চল এখনো ততটা ব্যাপক নয়, যতটা চা-এর।
তবে, আশ্চর্যের বিষয় হলো, কফির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এক দারুণ ঐতিহ্য, যা তুরস্কের সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। সুদীর্ঘ ইতিহাস আর বিশেষ কিছু রীতির কারণে, তুর্কি কফি শুধু একটি পানীয় নয়, বরং এটি একটি সংস্কৃতি, যা যুগ যুগ ধরে টিকে আছে।
কফির উৎপত্তির ইতিহাস বেশ পুরোনো। দ্বাদশ শতকে, ইয়েমেনের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে কফি বীজের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, এরপর ধীরে ধীরে কফি ছড়িয়ে পরে তুরস্ক, মিশর ও পারস্যে।
পঞ্চদশ শতকে, সুফি সাধু-সন্ন্যাসীরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রার্থনা করার জন্য জেগে থাকার উদ্দেশ্যে কফি পান করতেন। পরবর্তীতে, যখন সুলতান সোলাইমান ১৫৩৮ সালে ইয়েমেন জয় করেন, তখন কফি অটোমান সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে।
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, ১৫৫০ সালের দিকে ইস্তাম্বুলে প্রথম কফি হাউস বা ‘ক্যাফে’র আবির্ভাব হয়। এই কফি হাউসগুলো দ্রুতই সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
সেখানে রাজনৈতিক আলোচনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের আড্ডা চলত। কফি তৈরির বিশেষ পদ্ধতি— ‘সেজভে-ইব্রিক’ (cezve-ibrik), যা মূলত রান্নার একটি প্রক্রিয়া— তুর্কি কফির বৈশিষ্ট্য। এই পদ্ধতিতে কফি তৈরি করা হয়, যা একে সাধারণ কফি থেকে আলাদা করে।
তবে, কফি নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। ধর্মীয় পণ্ডিত ও রাজনৈতিক নেতারা কফি হাউসগুলোকে সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে করতেন। তাদের ধারণা ছিল, এখানে বসে মানুষজন সরকারবিরোধী আলোচনা করে।
এমনকি, সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসও কফি হাউস বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন।
তুর্কি কফি শুধু একটি পানীয় নয়, এটি বন্ধুত্বের প্রতীকও। তুরস্কের মানুষেরা যখন কারো সঙ্গে দেখা করেন, তখন তারা কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেন।
এর মাধ্যমে তারা সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ করেন।
কফি পরিবেশনেরও রয়েছে বিশেষ রীতি। গরম কফির সঙ্গে এক গ্লাস পানি এবং ‘লুকুম’ (lokum) বা তুর্কি মিষ্টি পরিবেশন করা হয়। পানি পানের কারণ হলো, কফির তেতো স্বাদ দূর করা এবং লুকুম খাওয়ার মাধ্যমে স্বাদের ভারসাম্য আনা।
কফি পানের পর কাপের তলার কফি নিয়ে ভবিষ্যৎ বলার রীতিও প্রচলিত আছে, যাকে ‘তাসোগ্রাফি’ (tasseography) বা কাপের ভবিষ্যৎ গণনা বলা হয়। যদিও ইসলামে ভবিষ্যৎ বলার বিষয়টি নিরুৎসাহিত করা হয়, তবে কফি কাপের এই পাঠকে তারা একটি আনন্দদায়ক সামাজিক রীতি হিসেবে দেখেন।
একটি মেয়ের বিয়ের সময়ও তুর্কি কফির এই সংস্কৃতি দেখা যায়। বিয়ের আগে, কনে তার হবু বরের জন্য কফি তৈরি করেন।
এরপর, বরের চরিত্র যাচাই করার জন্য কফিতে অতিরিক্ত লবণ মেশানো হয়। বর যদি কোনো অভিযোগ না করে কফি পান করেন, তবে ধরে নেওয়া হয়, তিনি ধৈর্যশীল এবং পরিণত মনের মানুষ।
আজও, তুরস্কের এই কফি সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করছে। বর্তমানে, অনেক তুর্কি নাগরিক অন্যান্য দেশে কফি বিষয়ক কর্মশালা ও অনুষ্ঠান করে থাকেন, যেখানে তারা ঐতিহ্যবাহী কফি তৈরির পদ্ধতি এবং এর সংস্কৃতি সম্পর্কে জানান।
সুতরাং, যদি কখনো তুরস্ক ভ্রমণে যান, তবে সেখানকার কফি অবশ্যই চেখে দেখবেন। কারণ, এক কাপ কফি আপনাকে তুরস্কের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করাবে, যা হয়তো আপনার মনকে অন্য এক জগতে নিয়ে যাবে।
তথ্য সূত্র: CNN