ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক “পুনরুদ্ধার”, ব্রেক্সিটের প্রায় এক দশক পরে নতুন চুক্তি। যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ব্রেক্সিটের (Brexit) পরবর্তী সময়ে তাদের সম্পর্ক “পুনরুদ্ধারের” লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে পৌঁছেছে।
এই চুক্তির ফলে মহাদেশের কয়েক কোটি মানুষের ভ্রমণ ও কাজের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে। সোমবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক শীর্ষ সম্মেলনে এই চুক্তিটি চূড়ান্ত হয়।
এই চুক্তিতে প্রতিরক্ষা, অভিবাসন, কর্মসংস্থান এবং ভ্রমণের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উভয় পক্ষের নেতারা আশা করছেন যে এর মাধ্যমে বহু বছরের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির অবসান হবে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার সোমবার এই চুক্তি উন্মোচনকালে বলেন, “এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমরা একটি নতুন অধ্যায় শুরু করছি।” স্টারমার আরও যোগ করেন, “ব্রিটেন আবার বিশ্ব মঞ্চে ফিরে এসেছে।”
তবে এই চুক্তির ফলে পুরোনো বিতর্কগুলো আবার মাথাচাড়া দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ব্রিটেনের ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা স্টারমারের সমালোচনা করে বলেছেন যে এই চুক্তি যুক্তরাজ্যের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করবে।
আসুন, এই চুক্তির প্রধান দিকগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:
বাণিজ্য সহজীকরণ:
চুক্তি অনুযায়ী, দুই পক্ষ তাদের মধ্যে বাণিজ্য সহজ করতে রাজি হয়েছে। ব্রেক্সিট আলোচনার সময় এটি ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর একটি।
ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা এখন থেকে ইইউ-তে খাদ্য ও পানীয় পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পাবে। যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রাণী ও উদ্ভিজ্জ পণ্যের কিছু নিয়মিত পরীক্ষাও এতে বাদ দেওয়া হবে।
স্টারমারের কার্যালয় আশা করছে যে এই পরিবর্তনের ফলে “খাদ্যের দাম কমবে এবং সুপারমার্কেটগুলোতে আরও বেশি পণ্যের সমাহার ঘটবে”। তবে তারা এটাও স্পষ্ট করেছে যে এই চুক্তি ইইউ-এর একক বাজার এবং শুল্ক ইউনিয়নের বাইরে থাকার বিষয়ে সরকারের মূল নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
উরসুলা ভন ডের লিয়েন সাংবাদিকদের বলেন, বাণিজ্য অংশীদাররা “একটি সাধারণ স্যানিটারি ও ফাইটোস্যানিটারি অঞ্চলের” দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে “চ্যানেলের উভয় প্রান্তের কৃষক, খাদ্য উৎপাদনকারী এবং মৎস্যজীবীদের জন্য আরও বেশি নিশ্চয়তা ও স্থিতিশীলতা আসবে।”
যুক্তরাজ্যের জন্য ইইউ-ই হলো সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ব্রিটেনের মোট রপ্তানির ৪১% এবং আমদানির অর্ধেকের বেশি এসেছে ইইউ থেকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্যও ব্রিটেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার।
চুক্তি অনুসারে, ইইউ-এর মাছ ধরার নৌকাগুলো বর্তমান চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আরও ১২ বছর পর পর্যন্ত ব্রিটিশ জলসীমায় প্রবেশ করতে পারবে। ইইউ-ও যুক্তরাজ্যের জন্য তাদের বিদ্যুতের বাজার উন্মুক্ত করতে রাজি হয়েছে।
ভন ডের লিয়েন এটিকে জ্বালানি নিরাপত্তা বাড়ানো এবং বিদ্যুতের দাম কমানোর একটি পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের কারণে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই চুক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইইউ এবং যুক্তরাজ্য সোমবার এক যৌথ বিবৃতিতে অবাধ, টেকসই, ন্যায্য ও উন্মুক্ত বাণিজ্যের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।
নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি:
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে যুক্তরাজ্য ও ইইউ-এর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপের নিরাপত্তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার এবং কিয়েভকে মস্কোর বিরুদ্ধে একা ফেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার পর এই সহযোগিতা আরও জোরদার হয়েছে।
সোমবারের চুক্তিতে একটি নতুন ইউকে-ইইউ প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ইউরোপীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তির জন্য বিড করতে পারবে।
ভন ডের লিয়েন বলেন, “এই যৌথ সংগ্রহ আমাদের প্রস্তুতি বাড়াবে এবং সামরিক দুর্বলতাগুলো দূর করবে।” স্টারমার এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তারা তাদের ইউরোপীয় প্রতিপক্ষদের সামরিক ব্যয় বাড়াতে এবং মস্কোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়দের জন্য পরিবর্তন:
চুক্তি অনুযায়ী, তরুণদের জন্য একটি “যুব গতিশীলতা প্রকল্প” চালু করা হবে। এর মাধ্যমে ৩০ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিরা যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের মধ্যে ভ্রমণ ও কাজ করতে পারবে।
স্টারমার জোর দিয়ে বলেছেন যে পূর্ণাঙ্গ অবাধ চলাচলের সুযোগ আর ফিরিয়ে আনা হবে না। তবে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা জোর দিয়েছেন যে এই চুক্তি উভয় পক্ষের জন্যই উপকারী হবে।
ব্রিটিশ শিক্ষার্থীরা আবারও ইউরোপের “ইরাসমাস স্কিম”-এর সুবিধা পাবে। এর মাধ্যমে তারা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে পড়াশোনা করতে পারবে।
ভন ডের লিয়েন বলেন, “এর ফলে আগামী প্রজন্ম একে অপরের দেশে বসবাস ও পড়াশোনা করতে পারবে। এটি সারা জীবনের বন্ধুত্বের জন্ম দেবে।”
ব্রেক্সিটের একটি দৃশ্যমান প্রভাবও দূর হতে চলেছে। এখন থেকে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারীরা ইউরোপীয় বিমানবন্দরগুলোতে ই-গেটের মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারবে, যা ইইউ পাসপোর্টধারীদের মতোই দ্রুত হবে।
এই চুক্তি কি পুরোনো বিতর্কগুলো উস্কে দেবে?
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্টারমার এই চুক্তি করছেন। জনমত তাঁর পক্ষে থাকলেও, ব্রিটেনের মানুষ ইইউ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন অনুশোচনা করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির চেয়ে ইইউ-এর সঙ্গে চুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেয় বলে জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে।
তবে ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট ভোটের পর ওয়েস্টমিনস্টারে যে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছিল, তা পুনরায় শুরু হওয়ার বিষয়ে দেশটি সতর্ক।
জনপ্রিয়তাবাদী “রিফর্ম ইউকে” পার্টি জনমত জরিপে এগিয়ে রয়েছে এবং ব্রেক্সিট আন্দোলনের মূল হোতা, দলের নেতা নাজেল ফারেজ ইতোমধ্যে এই চুক্তিকে ব্রাসেলসের কাছে আত্মসমর্পন হিসেবে অভিহিত করেছেন। কনজারভেটিভ নেতা কেমি ব্যাডেনকও অভিযোগ করেছেন, “আমরা আবারও ব্রাসেলসের নিয়ম-কানুন গ্রহণ করতে যাচ্ছি।”
তবে স্টারমার চাইছেন এই চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ রাজনীতিতে একটি বিতর্কিত অধ্যায়ের সমাপ্তি টানা হোক। তিনি বলেছেন, “এখন সামনের দিকে তাকানোর সময় এসেছে। পুরোনো বিতর্ক ও রাজনৈতিক লড়াই থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে ভালো হয় এমন বাস্তব সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন