২০৩০: ভয়াবহ ভবিষ্যৎ! সবার জীবনযাত্রায় বিপর্যয়, বাড়ছে দুশ্চিন্তা!

শিরোনাম: যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি: ২০৩০ সাল নাগাদ পরিবারগুলির জীবনযাত্রার মান কমতে পারে, দরিদ্র মানুষেরা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ যুক্তরাজ্যের সকল পরিবারের জীবনযাত্রার মান কমে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র পরিবারগুলো।

জীবনযাত্রার মানের এই অবনতি ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে, কারণ দলটি কর্মজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে জোসেফ রাউন্ট্রি ফাউন্ডেশন (JRF)। এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিশ্লেষণটি এমন এক সময়ে প্রকাশ করা হলো, যখন যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী র‍্যাচেল রিভস আগামী বুধবার সরকারের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই বাজেটে সরকারি খরচ কমানো হতে পারে, যা ঋণ বৃদ্ধি বা কর বাড়ানোর পরিবর্তে নেওয়া হতে পারে, যাতে সরকারের আর্থিক নিয়মকানুন বজায় থাকে।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ২০২৯ সালের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘কর্মজীবী মানুষের হাতে আরও বেশি অর্থ পৌঁছে দেওয়া’।

তবে লেবার পার্টির অনেক সংসদ সদস্য রিভসের এমন পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বিগ্ন, যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সহ বিভিন্ন সুবিধা কমানোর প্রস্তাব রয়েছে। যদি এমনটা হয়, তাহলে লেবার সরকারের আমলে জীবনযাত্রার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করবে, যা দলের মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়াবে।

JRF-এর বিশ্লেষণ বলছে, অফিস ফর বাজেট রেসপন্সিবিলিটি (OBR) ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড এবং অন্যান্য প্রধান পূর্বাভাসদাতাদের তথ্যের ভিত্তিতে তাদের পূর্বাভাস সংশোধন করবে। ধারণা করা হচ্ছে, এই বছর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ থেকে কমে ১ শতাংশ হতে পারে।

JRF তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, গত বছরটি সম্ভবত এই পার্লামেন্টের সময়কালের জন্য জীবনযাত্রার মানের সর্বোচ্চ সময় ছিল। তাদের বিস্তারিত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০৩০ সাল নাগাদ একটি পরিবারের গড় আয় ১৪০০ পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,৯৭,০০০ টাকা) পর্যন্ত কমতে পারে, যা তাদের ব্যয়ের যোগ্য আয়ের ৩ শতাংশ হ্রাস নির্দেশ করে।

এছাড়া, সবচেয়ে কম আয়ের পরিবারগুলো বছরে ৯০০ পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,২৭,০০০ টাকা) করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা তাদের ব্যয়ের যোগ্য অর্থের ৬ শতাংশ হ্রাস করবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যদি ২০৩০ সাল নাগাদ জীবনযাত্রার মানের উন্নতি না হয়, তবে স্টারমার কেবল তার প্রতিশ্রুতি পূরণেই ব্যর্থ হবেন না, বরং ১৯৫৫ সালের পর এই প্রথম কোনো সরকার পুরো মেয়াদে জনগণের জীবনযাত্রার মান হ্রাসের সাক্ষী থাকবে।

২০২৫ সালের সঙ্গে ২০৩০ সালের তুলনা করে দেখা গেছে, গড় মর্টগেজ গ্রহীতাদের বছরে প্রায় ১৪০০ পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,৯৭,০০০ টাকা) বেশি সুদ দিতে হবে এবং গড় ভাড়াটিয়াকে বছরে প্রায় ৩০০ পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪২,০০০ টাকা) বেশি ভাড়া দিতে হবে।

একই সময়ে, গড় আয় বছরে ৭০০ পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯৯,০০০ টাকা) পর্যন্ত কমতে পারে। JRF জানিয়েছে, ক্রমবর্ধমান আবাসন খরচ, প্রকৃত আয়ের পতন এবং করের সীমা অপরিবর্তিত থাকার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

JRF-এর পরিচালক আলফি স্টার্লিং বলেছেন, জীবনযাত্রার মান হ্রাসের এই ধারা পরিবর্তনের জন্য আরও বেশি করে সরকারি খরচ কমানো কোনো সমাধান নয়। বরং, রিভসের উচিত হবে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের ওপর কর বৃদ্ধি করার বিষয়টি বিবেচনা করা।

তিনি আরও বলেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সরকার অভ্যন্তরীণ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যন্ত বিভিন্ন অর্থনৈতিক চাপের মুখোমুখি হচ্ছে। তবে এই ঝুঁকিগুলো কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। দরিদ্র মানুষের সুযোগ সুবিধা কমিয়ে জনসাধারণের আর্থিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা ভুল এবং এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

সরকারের উচিত দারিদ্র্য বিমোচন এবং জীবনযাত্রার মান সরাসরি উন্নত করার দিকে মনোযোগ দেওয়া, যা তাদের উন্নয়নের কৌশল হিসেবে কাজ করবে। আর্থিক চাপ মোকাবিলায় কর সংস্কার করা যেতে পারে।’

গত সপ্তাহে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ফিনান্সিয়াল টাইমসকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তারা সতর্ক করে বলেছিলেন যে, মন্ত্রীদের জন্য সরকারি ব্যয় বা বিনিয়োগ কমানো ‘মারাত্মক ভুল’ হবে। তারা আরও যোগ করেন, ‘যুক্তরাজ্য কেবল খরচ কমিয়ে উন্নয়নের পথে যেতে পারে না।’

সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে, যেমন- কারাগার, বিচার বিভাগ এবং স্থানীয় সরকারে সম্ভবত আরও বেশি কাটছাঁট করা হতে পারে, যা স্টারমারের সেই দাবির ওপর প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে, যেখানে তিনি দেশকে কঠোরতা নীতিতে ফিরিয়ে না নেওয়ার কথা বলেছিলেন।

গত অক্টোবরের বাজেটে রিভস ৯.৯ বিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,৩৯,৬৫০ কোটি টাকা) ‘আর্থিক সুযোগ’ রেখেছিলেন, যা জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক বাজারে অপ্রত্যাশিতভাবে ঋণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবং প্রত্যাশার চেয়ে কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে সেই সুযোগ কমে গেছে।

ফলে, এখন তাকে হয় আয় বাড়াতে হবে, না হয় ব্যয় কমাতে হবে, অথবা উভয় পথেই হাঁটতে হবে।

স্থানীয় সরকার প্রধানরা বুধবারের বাজেট ঘোষণার জন্য উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন। কারণ তারা আশঙ্কা করছেন, এতে তাদের প্রাপ্ত অর্থ কমে যেতে পারে এবং অনেক কাউন্সিল দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। এর ফলে, সামাজিক সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলোতে অর্থ সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ার কাউন্সিলর লুইজ গিটিন্স বলেছেন, ‘যদি এখনই পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করা হয়, তবে আমরা সেই গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলো সরবরাহ করতে পারব না, যার ওপর এত মানুষ নির্ভরশীল এবং সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমাদের প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।’

এদিকে, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রীদের বেগ পেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রকাশিত একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, ক্ষমতায় আসার আট মাস পর লেবার পার্টির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের আস্থা কমছে।

জরিপে দেখা যায়, কোনো দলের নেতার প্রতিই এখন অর্থনীতির বিষয়ে মানুষের তেমন আস্থা নেই। তবে স্টারমার (-৩২%) এবং রিভস (-৩৮%) এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছেন।

সরকার নির্মাণ খাতে শ্রমিক সংকট কাটাতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে। এর অংশ হিসেবে, নির্মাণ খাতে আরও ৬০,০০০ কর্মী নিয়োগের জন্য ৬০০ মিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮,৪৬০ কোটি টাকা) ব্যয় করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী র‍্যাচেল রিভস বলেন, ‘আমরা ব্রিটেনকে আবার নির্মাণ কাজে উৎসাহিত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এজন্য আমরা ১৫ লক্ষ নতুন বাড়ি তৈরি এবং সড়ক, রেল ও জ্বালানি অবকাঠামো পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছি।

প্রকৌশলী, রাজমিস্ত্রি, ইলেক্ট্রিশিয়ান এবং অন্যান্য দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। আমরা এই সংকট কাটাতে চাই।’

ট্রেজারি মুখপাত্র বলেছেন, ‘বাস্তব মজুরি গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়ছে। তবে এই সরকার এমন এক পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় এসেছে, যখন জীবনযাত্রার মানের প্রবৃদ্ধি ছিল সর্বনিম্ন। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে, মানুষের হাতে আরও বেশি অর্থ পৌঁছে দেওয়া আমাদের প্রধান লক্ষ্য।’

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *