বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার হচ্ছে, আর এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিভিন্ন কৌশল নিয়ে গবেষণা চলছে। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো কার্বন ক্যাপচার বা কার্বন শোধন প্রযুক্তি।
শিল্পকারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) গ্যাসকে সরাসরি ধরে তা মাটির নিচে জমা করা অথবা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে কার্বন ক্যাপচার বলা হয়। সম্প্রতি, যুক্তরাজ্যে সমুদ্র থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোধনের একটি নতুন প্রকল্প শুরু হয়েছে, যা পরিবেশ সুরক্ষার দৌড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
যুক্তরাজ্য সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন ক্যাপচার প্রকল্পগুলোতে প্রায় ২০ বিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় হিসাব করলে, প্রায় ২.৭৭ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের বিনিময় হার অনুযায়ী) বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে, ‘সি-কিউরি’ (SeaCURE) নামে একটি প্রকল্প ইংলিশ চ্যানেলের কাছাকাছি ওয়েমাউথ সি লাইফ সেন্টারে (Weymouth Sea Life Centre) পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে।
এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো সমুদ্রের জল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করা এবং এটি কতটা কার্যকর তা পরীক্ষা করা।
সমুদ্রে কার্বন ক্যাপচারের ধারণাটি বেশ অভিনব। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাতাস থেকে সরাসরি কার্বন ডাই অক্সাইড শোধন করার চেয়ে সমুদ্রের জল থেকে এটি অপসারণ করা বেশি কার্যকর হতে পারে। কারণ, সমুদ্র হলো পৃথিবীর বৃহত্তম কার্বন ভাণ্ডার, যা পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে।
সি-কিউরি প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রের পানিতে কার্বনের ঘনত্ব বাতাসের চেয়ে অনেক বেশি, ফলে এই পদ্ধতিতে কার্বন ক্যাপচার করা তুলনামূলকভাবে সহজ হতে পারে।
এই প্রকল্পের পাইলট প্ল্যান্টে (pilot plant) প্রতি মিনিটে ৩,০০০ লিটার সমুদ্রের জল শোধন করার ক্ষমতা রয়েছে। এই প্ল্যান্ট বছরে প্রায় ১০০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সমুদ্রের জল থেকে কার্বন আলাদা করার জন্য জলের অম্লতা সামান্য বাড়ানো হয়, যার ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। এরপর এই গ্যাসকে সক্রিয় কার্বন ব্যবহার করে পরিশোধিত করা হয় এবং তা সংরক্ষণের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
পরিশোধিত জলকে আবার সমুদ্রে ফেরত পাঠানো হয়, যা পুনরায় বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম।
তবে, সমুদ্র থেকে কার্বন ক্যাপচারের এই পদ্ধতি নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, পরিশোধিত জল পরিবেশে ছাড়ার আগে এর গুণাগুণ বজায় রাখা এবং সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের উপর এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বিবেচনা করা জরুরি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে নির্গত জল সামুদ্রিক পরিবেশের উপর তেমন কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না, কারণ এটি খুব দ্রুত পানির সঙ্গে মিশে যায়।
কার্বন ক্যাপচারের ধারণাটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে এর সম্ভাবনা অনেক। বর্তমানে বিশ্বে ৬০০-র বেশি কার্বন ক্যাপচার ও স্টোরেজ প্রকল্প চলমান রয়েছে এবং এই খাতে বিনিয়োগও বাড়ছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির বাজার ছিল প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩২ সাল নাগাদ ১৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তাই, সমুদ্র থেকে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি যদি সফল হয়, তবে তা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হতে পারে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে যেমন কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব, তেমনি দেশের পরিবেশ সুরক্ষায়ও এটি সহায়ক হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে, তবে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। ভবিষ্যতে, এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হবে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন