ইউক্রেনের ড্রোন: গভীর আক্রমণে কাঁপছে রাশিয়া, যুদ্ধের মোড় ঘুরছে!

**ইউক্রেনের ড্রোন হামলা: রাশিয়ার তেল উৎপাদন কেন্দ্রে আঘাত, যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন**

যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে ইউক্রেনের দূরপাল্লার ড্রোন হামলা। রাশিয়ার অভ্যন্তরে গভীর অঞ্চলে আঘাত হানছে এইসব ড্রোন, যা দেশটির সামরিক এবং জ্বালানি অবকাঠামোর উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই ড্রোন হামলার তীব্রতা বেড়েছে, যার ফলস্বরূপ রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে জ্বালানি সংকট, এমনকি কিছু জায়গায় রেশনও চালু করতে হয়েছে।

ইউক্রেনীয় বাহিনী রাতের অন্ধকারে, শব্দহীন পরিবেশে এই ড্রোনগুলো তৈরি করে এবং রাশিয়ার দিকে পাঠায়। এইসব ড্রোনের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হলো তেল শোধনাগার, জ্বালানি ডিপো এবং সামরিক লজিস্টিক কেন্দ্রগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা কার্নেগি এনডাউমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ইউক্রেনীয় ড্রোনগুলো রাশিয়ার ১৬টি প্রধান তেল শোধনাগারে আঘাত হেনেছে, যা দেশটির মোট শোধনাগার ক্ষমতার প্রায় ৩৮ শতাংশ।

তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, হামলার সরাসরি প্রভাব ততটা গুরুতর নয়, কারণ অধিকাংশ প্ল্যান্ট কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া, রাশিয়ার অতিরিক্ত জ্বালানি মজুত এবং অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে।

কিন্তু, ইউক্রেনের এই দূরপাল্লার হামলার ফলে যুদ্ধের মোড় অনেকটাই তাদের দিকে ঝুঁকেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও জোরদার করছে, অন্যদিকে ইউক্রেনও তাদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, তাদের উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা রাশিয়ার জন্য ব্যাপক ক্ষতির কারণ হচ্ছে, যার ফলে রাশিয়াকে জ্বালানি আমদানি করতে এবং রপ্তানি কমাতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘ফিদেল’ নামের একজন ইউক্রেনীয় কমান্ডার জানিয়েছেন, ড্রোনগুলো এখন এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে সক্ষম। তিনি বলেন, “ড্রোন প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে।

আগে যেখানে তারা ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারত, এখন এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। একটি সফল অভিযানের জন্য তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ: ড্রোন, মানুষ এবং পরিকল্পনা।

আমরা সেরা ফল দিতে চাই। আমাদের জন্য, এটা একটা পবিত্র দায়িত্ব।”

এই ড্রোনগুলোর বেশিরভাগই তৈরি হচ্ছে ইউক্রেনে। ‘লিউটি’ নামের একটি ড্রোন, যা দেখতে খুব সাধারণ, আক্রমণের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে।

এটির সহজলভ্য যন্ত্রাংশ ব্যবহারের কারণে একে সহজেই লুকিয়ে রাখা যায় এবং নিয়মিতভাবে উন্নত করা যায়।

এই ড্রোনগুলো তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার। রাশিয়ার অভ্যন্তরে এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারার ক্ষমতা এই সংঘাতের ভূগোল পরিবর্তন করেছে।

আগে মূলত রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে হামলা হতো, কিন্তু এখন তা অনেক গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অ্যাড্রিয়ানো বোসোনি বলেছেন, “আমরা দেখছি, ইউক্রেন এখন রাশিয়ার ভেতরে যুদ্ধ নিয়ে যেতে আরও পারদর্শী হচ্ছে।

যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় ধরে রাশিয়া ধরে নিয়েছিল যে তাদের ভূখণ্ড নিরাপদ। কিন্তু এখন আর সেই ধারণা নেই।”

প্যারিস-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (IEA) এর মতে, ইউক্রেনের ড্রোন হামলার কারণে রাশিয়ার দৈনিক প্রায় ৫ লক্ষ ব্যারেল তেল শোধন করার ক্ষমতা কমে গেছে।

এর ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানির সংকট দেখা দিয়েছে এবং ডিজেল ও জেট ফুয়েলের রপ্তানিও কমেছে, যদিও বিশ্ব বাজারে তেলের উৎপাদন এবং দাম স্থিতিশীল রয়েছে।

ইউক্রেনের নিজস্ব ড্রোন তৈরির সক্ষমতা তাদের পশ্চিমা দেশগুলোর সাহায্য ছাড়াই হামলা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।

আগে দূরপাল্লার অস্ত্র পেতে পশ্চিমা দেশগুলোর অনুমতির প্রয়োজন হতো, কিন্তু এখন তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে।

তবে, প্রতিটি মিশনের পেছনে রয়েছে অনেক হিসাবনিকাশ। কমান্ডার ফিদেল জানিয়েছেন, “আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশের জন্য যুদ্ধ করছি।

আমরা এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করছি যা বিশ্বের প্রতিটি দেশ ব্যবহার করবে, এবং এর জন্য আমরা আমাদের জীবন ও বন্ধুদের জীবন উৎসর্গ করছি।”

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *