স্বাধীনতা: রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের দীর্ঘ লড়াই!

**ইউক্রেনের স্বাধীনতা: অতীতের ভুল আর রাশিয়ার ছায়া**

নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেন ভেবেছিল, তাদের স্বাধিকারের লড়াই হয়তো কয়েক দশক ধরে চলবে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হতে সময় লেগেছিল খুবই কম।

১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং গণভোটে দেশটির ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এর পক্ষে রায় দেয়।

স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ওলেক্সান্ডার দোনি বলেন, “আমি জেল ও শ্রম শিবিরের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। ভেবেছিলাম, সংগ্রামটা হয়তো ২০-৩০ বছর চলবে।

কিন্তু স্বাধীনতা এলেও মস্কোর প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া এত সহজ ছিল না। রাশিয়া রাজনৈতিক চাপ, সামাজিক বিভেদ তৈরি এবং পশ্চিমা-পন্থী কণ্ঠস্বরগুলোকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়ে যায়।

এর ফলস্বরূপ, কয়েক দশক পর ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন দেখা যায়। বর্তমানে ইউক্রেন তাদের স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য প্রতিবেশী দেশটির বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

১৯৯০ সালে দোনি এবং অন্যান্য ছাত্রনেতারা শুধু মস্কো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতেও সোচ্চার হয়েছিলেন। তাদের প্রথম প্রস্তাব ছিল ইউক্রেনের পার্লামেন্টের দ্রুত নির্বাচন করা।

কিন্তু স্বাধীনতা-পন্থী শক্তিগুলোর মধ্যেও এই ধারণা তেমন সমর্থন পায়নি।

দোনি’র মতে, “ইউক্রেন স্বাধীনতা অর্জন করলেও কমিউনিস্ট শাসকগোষ্ঠীর অপসারণ হয়নি।

তাঁর ধারণা, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সুযোগগুলো হাতছাড়া হওয়ার কারণে ইউক্রেনকে আজ অনেক বড় মূল্য দিতে হচ্ছে। দেশটি এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে যোগ দিতে চাইছে, যা তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রথম ইউক্রেনীয় পার্লামেন্টের সদস্য ওলেক্সান্ডার নেচিপোরেনকো সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, স্বাধীনতার প্রাক্কালে সমাজ কতটা বিভক্ত ছিল।

“অধিকাংশ মানুষ ছিল নিরপেক্ষ, দ্বিধাগ্রস্ত। আবার অনেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট শাসন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে ছিল।

নেচিপোরেনকোর মতে, “পরিবর্তনকামী” মানুষের সংখ্যা ছিল খুবই কম।

নেচিপোরেনকোর মতে, স্বাধীনতার পর ইউক্রেন রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছিল, যা ছিল একটি বড় ভুল। “আমাদের আরও দৃঢ়, আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল,” তিনি বলেন।

এই দৃঢ়তার অভাব শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। স্বাধীনতার প্রাথমিক বছরগুলোতে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত আজও ইউক্রেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর মধ্যে অন্যতম ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেনের ভূখণ্ডে থাকা বিশাল পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার ত্যাগ করা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইউরি কোস্টেনকো, যিনি নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ইউক্রেনের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি বলেন, “আমাদের বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার ছিল, যা প্রায় পাঁচ হাজার পারমাণবিক ওয়ারহেডের সমান। এই অস্ত্র ভাণ্ডারকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যেত।

কোস্টেনকোর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পারমাণবিক ওয়ারহেডগুলোকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানিতে রূপান্তর করার পরিকল্পনা ছিল।

ন্যাটোতে যোগদানের মাধ্যমে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকলেও, রাশিয়া ইউক্রেনকে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার কাছে সমর্পণ করতে চাপ দেয়।

বিনিময়ে ইউক্রেন রাশিয়া থেকে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পারমাণবিক জ্বালানি ও প্রাকৃতিক গ্যাস পেয়েছিল, যা কোস্টেনকোর মতে, ইউক্রেন যে পরিমাণ সম্পদ ত্যাগ করেছে, তার মাত্র ১ শতাংশের সমান ছিল।

ন্যাটোতে যোগদানের পরিবর্তে ইউক্রেন ‘বুদাপেস্ট মেমোরান্ডাম’ চুক্তি পায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার নিশ্চয়তা দেয়।

কিন্তু অনেক ইউক্রেনীয়র কাছে এটি ছিল একটি ফাঁকা প্রতিশ্রুতি। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়া নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে এবং ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন চালিয়ে এই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে।

অতীতে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো আজও ইউক্রেনের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এই সময়ে, পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করার সময়, নব্বইয়ের দশকের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি।

তথ্য সূত্র:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *