যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন পরিস্থিতি : কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ, অচলাবস্থা আর অনিশ্চয়তা।
ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধ বন্ধের উদ্দেশ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা চললেও, এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বরং আলোচনার টেবিলে বসার পরেও পরিস্থিতি কার্যত আগের মতোই রয়েছে।
বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বুকে এটিই সবচেয়ে বড় সংঘাত। এমন পরিস্থিতিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা খুব দ্রুতই স্থিমিত হয়ে পড়ে।
আলোচনায় মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে – বন্দী বিনিময়, দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে সম্ভাব্য বৈঠক এবং যুদ্ধবিরতির রূপরেখা তৈরি। এই বিষয়গুলোকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হলেও, বাস্তবে তেমন কোনো ফল আসেনি।
বন্দী বিনিময় একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া, আর ইউক্রেন শুরু থেকেই শর্তহীন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। তারা প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাবও দিয়েছিল।
কিন্তু রাশিয়া সেই প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করেনি। যদিও পরে তারা বিষয়টি বিবেচনা করার কথা জানিয়েছে।
গত কয়েকদিনে কূটনীতি অনেক দূর এগিয়ে গেলেও, ফল হয়েছে শূন্য। আলোচনার শুরুটা হয়েছিল কিয়েভে, যেখানে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা ইউক্রেনে এক মাসের জন্য শর্তহীন যুদ্ধবিরতির দাবি জানান।
একইসঙ্গে, তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারিও দেন।
এরপর আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় একই পাঁচ নেতার একটি ছবি দেখা যায়, যেখানে তাঁরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ রাশিয়ার যুদ্ধবিরতি এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার বলেন, শান্তি ফিরিয়ে আনতে না চাওয়ার জন্য পুতিনকে ‘মূল্য দিতে হবে’।
আলোচনা এবং ছবিগুলোর পুনরাবৃত্তি বেশ লক্ষণীয় ছিল। এই সময়ে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও কূটনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
পুতিন যুদ্ধবিরতির দাবিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে ইস্তাম্বুলে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দেন। জেলেনস্কি সেখানে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে রাজি হন।
ট্রাম্প মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু পুতিন শুধুমাত্র একটি জুনিয়র পর্যায়ের বৈঠকের জন্য রাজি হন। ট্রাম্প পরে জানান, তিনি আশা করেননি যে পুতিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে ইস্তাম্বুলে যাবেন।
ইউরোপীয় নেতারা শুক্রবারের আলোচনা কীভাবে সামলেছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে তাঁরা নিশ্চয়ই ট্রাম্পকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো মনে করিয়ে দিয়েছেন।
ট্রাম্প প্রকাশ্যে পুতিনের সমালোচনা করতে বা তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করতে দ্বিধা বোধ করেন। ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সঙ্গে তাঁর এই দ্বিধা, বিশেষ করে ম্যাক্রোঁ এবং স্টারমারের মতো নেতাদের সঙ্গে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
এই এক সপ্তাহে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন বিষয়ক বৈদেশিক নীতিতে অনেকবার তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। এর ফলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, পুতিন ইউরোপ বা আমেরিকার চাপ তেমন একটা আমলে নিচ্ছেন না।
তিনি কেবল আলোচনার টেবিলে আসার জন্য কিছু প্রস্তাব দিচ্ছেন, কিন্তু কোনো ছাড় দিতে রাজি নন। অন্যদিকে, ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে ইউক্রেন এবং তার মিত্রদের সমর্থন জানালেও, প্রকাশ্যে ক্রেমলিনের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছেন।
হোয়াইট হাউস মাঝে মাঝে পুতিনের প্রতি তাদের ধৈর্য্যের অভাবের কথা জানালেও, বাস্তবে ইউরোপের চাওয়া অনুযায়ী কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
রাশিয়া কৌশলগতভাবে ধীরে ধীরে শান্তি আলোচনার দিকে এগোচ্ছে, যা ট্রাম্পকে তাদের গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। এর ফলে রাশিয়া কোনো ছাড় না দিয়েই আলোচনার টেবিলে নিজেদের সক্রিয় প্রমাণ করতে চাইছে।
সম্প্রতি শোনা গেছে, রাশিয়া ইউক্রেনের কিছু এলাকা তাদের দখলে নিতে চাইছে।
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্রিজেট ব্রিঙ্ক গত মাসে পদত্যাগ করেন। তিনি তাঁর পদত্যাগের কারণ হিসেবে জানান, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ছিল আগ্রাসী রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, বরং ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেনের উপর চাপ সৃষ্টি করা।
তাঁর মতে, ‘যেকোনো মূল্যে শান্তি’–র নীতি আসলে ‘তুষ্টিকরণের’ নামান্তর। ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, এই ধরনের নীতি নিরাপত্তা, সুরক্ষা বা সমৃদ্ধি বয়ে আনে না, বরং তা আরও যুদ্ধ ও দুর্ভোগের দিকে নিয়ে যায়।
ট্রাম্পের নরম নীতি শেষ পর্যন্ত ‘তুষ্টিকরণ’-এর পর্যায়ে পৌঁছায় কিনা, তা বলা কঠিন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই দ্বিধা, মস্কোর উপর চাপ কমানোর ইঙ্গিত দেয়, যা উদ্বেগের কারণ।
ট্রাম্প, জেলেনস্কি এবং পুতিনের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত শীর্ষ বৈঠক থেকেও তেমন কোনো ফল আসবে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
সম্ভবত এই বৈঠকের মাধ্যমে কূটনীতির চাকা নতুন করে ঘুরতে পারে, কিন্তু ইউক্রেনের জন্য পরিস্থিতি হয়তো আগের মতোই থাকবে – শূন্য।
তথ্য সূত্র: সিএনএন